অফিসে সহকর্মীর সঙ্গে সুসম্পর্ক!
অফিসে সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? শীতল পেশাদারি নাকি উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক? অফিস কি শুধুই কাজের জায়গা, নাকি নিজ ঘরের বাইরে আরেকটি আবাস? দিনের ১২ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময়টা সহকর্মীদের সঙ্গে কাটাই আমরা। পরিবারের চেয়েও বেশি সময় কাটে এঁদের সঙ্গেই। কর্মক্ষেত্রকে তাই অনেকে বলেন ‘দ্বিতীয় ঘর’। সেই ‘দ্বিতীয় ঘর’—এ যাঁদের সঙ্গে থাকছেন, তাঁদের সঙ্গে সহজ, সাবলীল, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কিন্তু কাজে আনন্দ এনে দেয়। কাজের মানও ভালো হয়। কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিকতায় অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা কিন্তু বেশ বড় চ্যালেঞ্জ।
চাওয়া-পাওয়া, দেনা-পাওনা, সুযোগ-সুবিধা প্রতিটি সম্পর্কের সেতু। অফিসেও এর ব্যত্যয় ঘটে না, সেটা সহকর্মী হোক নারী কিংবা পুরুষ। আমরা সবাই জানি এবং বুঝি, অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক হওয়া উচিত। কিন্তু এই ‘নীতি কথা’ সব সময় মানা হয় না, কিংবা মানা যায় না। টানাপোড়েন ছাড়া কোনো সম্পর্ক হয় নাকি! অফিস যদি ‘পরিবার’ই হয়, সেখানে মান-অভিমান তো থাকবেই। থাকতে হবে পাশে দাঁড়ানোরও নিদর্শন। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন ও নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি কাজে আনন্দ পেতে অফিসে তাই সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জরুরি। তবে জোর করে তো আর দোস্তি হয় না। সেটি যদি না-ও গড়তে পারেন, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের বিকল্প নেই।
আগে নিজেকে জানুন:
সহকর্মীদের জানার চেষ্টা করার আগে নিজেকে জানুন। মানে, নিজের আগ্রহের জায়গাগুলো চিহ্নিত করুন। অফিসে কাজের ফাঁকে সহকর্মীরা কিন্তু নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। আপনার ব্যক্তিত্বের ধরন, আপনি অন্তর্মুখী নাকি মিশুকে। আড্ডাবাজ নাকি চুপচাপ। এই চরিত্র বাকিদেরও বুঝতে সাহায্য করুন। নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে জোর করে কিছু করবেন না। নিজেকে মেলে ধরুন। দেখবেন, আপনি নতুন কর্মী হলেও ঠিক সেখান থেকেই সবার সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হতে শুরু করবে।
সম্পর্কের সীমারেখা টানুন:
সহকর্মী নারী বা পুরুষ হোক, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই কাম্য। নারী সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করতে করতে একসময় প্রেম হতে পারে। এটা মোটেও অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, প্রেমের এই সম্পর্ক যেন আপনার বাকি সহকর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না করে। অফিসে এমন কিছু করবেন না, যা প্রেমের সম্পর্ককে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। এতে সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও সেটা টিকে থাকে না। এ জন্য অফিসে সবার সঙ্গেই সুসম্পর্কের সীমারেখা টানাও জরুরি। মাত্রাতিরিক্ত সৌহার্দ্য কিন্তু সুসম্পর্ক নয়, বিপদে পড়ার ফাঁদ!
বিনয়ী হোন
সব সহকর্মীর সঙ্গে আচরণে কথাবার্তায় বিনয়ী হয়ে ওঠা জরুরি। উদ্ধত আচরণ মানুষকে ধীরে ধীরে একা করে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে বিনয় এমন একটি ‘অস্ত্র’, যা দিয়ে অফিসে আপনার সবচেয়ে বড় শত্রুকেও বশ মানাতে পারবেন। বিনয় মানে ‘গলে যাওয়া’ কিন্তু নয়। আত্মবিশ্বাসী মানে যেমন নয় উদ্ধত অহংকার। ধৈর্য কিংবা বিনয় কখনোই চারিত্রিক দুর্বলতা নয়, এসব কারও সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্কের হাতিয়ার।
সহযোগিতা করুন
অফিস মানেই ‘দলগত অংশগ্রহণ’—সেখানে সহকর্মীরা একে-অপরকে সাহায্য করে কাজ সম্পন্ন করবেন, এটাই নিয়ম। আপনার অসহযোগিতা শুধু সেই কাজকেই প্রভাবিত করবে না, বরং সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কেও রাখবে নেতিবাচক প্রভাব। মনে রাখবেন, ভালো সহকর্মী হতে চাইলে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। অফিসে নিজের কাজের বাইরে সহকর্মীদের কাজে টুকটাক সহযোগিতা করুন। অন্তত তাঁর পিসিটা ঠিকমতো কাজ করছে না, আইটি বিভাগের লোকজন আসার আগে নিজে একটু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এই সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করুন কর্মক্ষেত্রের বাইরেও। বিপদ-আপদ সবার হয়। সেই বিপদে সবার আগে পাশে দাঁড়ায় যে, সেই তো স্বজন। আপনার পাশে প্রতিদিন এত সময় কাটান যে মানুষটা, তাঁর বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ান। নতুন কর্মীকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করুন।
সম্মানবোধ জরুরি
মানুষে মানুষে সম্মান দেওয়া-নেওয়া থেকে সুসম্পর্কের সৃষ্টি হয়। অফিসে সহকর্মীদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক তা-ই। যেকোনো কাজে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিন। অফিসে এ চর্চাটা সহকর্মীদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। কেননা, আপনি নিজেকে অফিসের অংশ হিসেবে মনে করলেই কেবল সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইবেন। সে ক্ষেত্রে, সহকর্মীরা আপনার মতামতের গুরুত্ব না দিলে অফিসের অংশ হয়ে উঠবেন কীভাবে? এ জন্য সহকর্মীদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সম্মানবোধটা জরুরি। ছোটখাটো কাজে এসব সম্মানবোধ গড়ে তোলে বড় মাপের বোঝাপড়া, যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় অফিস।
ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ভুলে যান
গোটা বিশ্বের সব অফিস-আদালতেই এ সমস্যাটা আছে। পরনিন্দা, পরচর্চা কিংবা সবকিছু বাঁকা দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস অফিসের পরিবেশকে দূষিত করে তোলে। এসব বদভ্যাস থাকলে আপনি কখনোই সহকর্মীদের মন জয় করতে পারবেন না। কোনো একটি ঘটনা শুনলেই তা পাঁচ কান করার অভ্যাস সহকর্মীদের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। অফিসে প্রেম নিয়ে রসাল আলোচনাও নিচু মানসিকতার পরিচায়ক। এসব কোনো
সহকর্মীই ভালো চোখে দেখেন না।
অফিসে মূল্যায়নের সময় সব সময় যে আপনার প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে, তা-ও নয়। কিন্তু সেটির সমাধান ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব খোঁজা নয়। এতে নিজের কাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাবই কিন্তু পড়ে। মনে রাখবেন, অফিসে আপনার উন্নতি কিন্তু সহকর্মীর মূল্যায়নের ওপরও নির্ভর করে। সহকর্মীদের তীব্র অসন্তোষের মুখে এই পর্যন্ত কেউ কর্মক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে, এমনটা শোনা যায় না। সহকর্মীর কাজের যৌক্তিক প্রশংসা করুন। কাজের ফাঁকে রসিকতা করুন, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হবে, কাজেও মন হয়ে উঠবে চনমনে।
প্রতিযোগিতা হোক স্বাস্থ্যকর
স্কুলে এমনটা অনেকের হয়। স্কুলের বন্ধুদের চেয়ে আপন নেই। কিন্তু এই বন্ধুদের সঙ্গেই নম্বর তোলার প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রতিযোগিতা খারাপ তো নয়। ও ভালো করছে, আমাকে ওর চেয়ে ভালো করতে হবে—এই স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলুন। আপনি আপনার সহকর্মীকে পেরিয়ে যেতে চাইছেন, এটা খোলাখুলিই বুঝিয়ে দিতে পারেন। সেটা এই বার্তা দিয়ে, আমি তোমার চেয়ে বেশি কাজ করব, ভালো কাজ করব। পারলে তুমিও এই চ্যালেঞ্জ নাও।
শেষ কথা
বড় অফিস একান্নবর্তী পরিবারের মতো। কারও পাতে কখনো একটু বেশি ওঠে, কারও পাতে কম। কেউ মাছের মুড়োটা পাবে, কেউ পেটি, কারও কপালে লেজ। কিন্তু এটা বারবার হচ্ছে কি না, কেন হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করুন। নিজে ছাড় দিয়েও যখন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কিছু মিলছে না, তখন ভাবতে হবে, চাকরিটাই বোধ হয় আপনার জন্য নয়।