নস্তাত্ত্বিক আত্মকথন

জিএস নিউজজিএস নিউজ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ১০:২৫ এএম, ০৮ জুন ২০১৮

স্টাফ রিপোর্টার:>>>

তরুণ কবি আদ্যনাথ ঘোষ বেশ বছর ধরেই দেশের খ্যাতনামা জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় কবি হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন এবং প্রায় প্রতিটি গ্রন্থমেলায় তিনি একাধিক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে পাঠকদের দৃষ্টি কাড়তে যথার্থই সক্ষম হয়েছেন।

হাজার বছরের বাংলা কবিতার মানচিত্রে আধুনিক বাংলা কবিতার যে-তাৎপর্যপূর্ণ অহংকার, চলতি সময়ের বাংলা কবিতা সেই ক্রমবিবর্তনের শাণিত ধারায় প্রায় যেন এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। একালের কবিরা বাংলা কবিতা থেকে অলৌকিকতার সব অযৌক্তিক মোহকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে বাস্তবিক বস্তুগত সৌন্দর্য, প্রকৃতির অপার বিস্ময় ও ভাববাদের সমন্বয়ে জীবনধর্মী সমান্তরাল রূপরেখার চিত্রকল্প এঁকে চলতে যথার্থই সক্ষম।

কেননা তরুণ প্রজন্মের লিখিয়েরা অবশ্যই অনুধাবন করতে পেরেছেন- কবিরহৃদস্পন্দন হলো কবিতা। কাজেই তারাও চেষ্টা চালিয়ে যান, যেন কবিতা পাঠমাত্রই মননশীল পাঠকচোখে কবির অন্তর্গত স্পন্দনটুকু অনায়াসে ধরা পড়ে। আর সেই সূত্র ধরে খোলাখুলিভাবে বলা যেতে পারে- তরুণ প্রজন্মের আলোচিত কবি, কবি আদ্যনাথ ঘোষের কাব্যগ্রন্থসমূহ হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক, বহুবর্ণিল এবং স্বপ্নবাদী।

কবি আদ্যনাথ ঘোষের ‘জন্মভূমি তুমি মাগো’ কাব্যগ্রন্থের বিষয়াবলি যেন সূচনালগ্ন থেকেই এক ভিন্ন আবহে আন্দোলিত। যা প্রকারান্তরে দ্রোহ-বিদ্রোহের সংমিশ্রণে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে একটি সূতীক্ষ্ম বিরুদ্ধবাদী তলোয়ার আবার চেতনার তলোয়ার বলেও ভুল হবে না।

অন্যদিকে তার ‘হৃদয়ে উতল হাওয়া’ কিংবা ‘আমি তোমাদেরই একজন’ কাব্যগ্রন্থে কবি স্বয়ং স্বদেশ ও স্বভাষার প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগে উদ্বেলিত হয়ে, স্বাধিকার চেতনায় জোয়ারে স্ফীত হয়ে তার নিজস্ব কাব্যভুবনে তাত্ত্বিকগত দিক থেকে পূর্ণতার দিকে হেঁটেছেন আর বলা বাহুল্য এটা ঘটেছে, তার ভেতরের অকৃত্রিম দেশপ্রেমবোধ মানবতাবোধ এবং প্রচণ্ড জাতীয়তাবোধের কারণে।

বর্তমান সময়ের কবিতাপাঠক অনুসন্ধিৎসু গবেষকের মতো। তারা কালনিরপেক্ষ কবিতার ভেতর থেকে কেবল চিন্তা আর বোধটুকু লুফে নেয়; যদি কিনা আঙ্গিক বা প্রকরণকে ধরে রাখা যায় কালের ভঙ্গিমায়। কাজেই সচেতন পাঠকের দৃষ্টিতে মনে হতে পারে সম্প্রতি আলোচিত কবি, আদ্যনাথ ঘোষ যেন তার কবিতায় কালকে অতিক্রম করতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হয়েছেন, আর সে-কারণে যেন তার কবিতা যতটা না বুদ্ধিবৃত্তিক হয়েছে, তারচেয়ে বেশি হয়েছে হৃদয়বৃত্তিক। কারণ তার কবিতার নিতান্ত সাদামাটা দুরূহতা পাঠককে বারে বারে পিছলে ফেলে দেয় স্মৃতিসঞ্চিত জীবনানুভূতির বধ্যভূমে।

হাজারো বৈষম্যের কারণে বাঙালিরা প্রচণ্ডভাবে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিপীড়িত ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কবি আদ্যনাথ ঘোষের প্রায় প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থেই ভাষা-আন্দোলন এবং স্বাধিকার সংগ্রামের উদ্দীপ্তবোধ জায়গা করে নিয়েছে বহুলাংশে।

একই সঙ্গে বাঙলার মা-মাটি ও বাঙলার অপরূপা নিসর্গের প্রতি কবির সুগভীর মমতাবোধ এবং ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবিসত্তার বাস্তবিক শৈল্পিকচেতনার মধ্য দিয়ে। এ কারণে পাঠক খুব সহজেই তার কাব্যের তরুলতা ফুটে উঠতে দেখতে পাবেন।

এই প্রসঙ্গে বলা বাহুল্য-কাব্যবোধে ও রসে নান্দনিকভাবে, সূক্ষ্মশিল্পীতার সঙ্গে যিনি এর সফল প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম, তিনি তত মহত্তর কবি। মোটকথা ভাবকে যথার্থ ভাষায় পরিস্ফুটিত করা এবং শব্দের মাধুর্য ও সৌন্দর্যবোধকে যথার্থভাবে অর্থপূর্ণতা দিতে পারাটাই হলো কবির সার্থকতা। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ কবিতার ভাবার্থের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে এবং অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত। অর্থকে বাদ দিয়ে অযাচিত শব্দালংকরণ গ্রহণযোগ্য নয়।

কারণ অলংকারের কোনো নিজস্ব সৌন্দর্য নেই। আর একইসঙ্গে এ কথাও ঠিক যে, কবিতায় শব্দ অপরিহার্য বটে; কিন্তু সেই-ই আবার একমাত্র উপাদান নয়। কাজেই শিল্পমাধ্যমে কবিতার মহত্ত্ব বিচারে আপাদমস্তক কবি আদ্যনাথ ঘোষের কবিতা বিশুদ্ধতম কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম। সন্দেহ নেই নিজেকে প্রকাশ করারই একটা ভিন্ন মাধ্যম হলো কবিতা।

আর এই ক্ষেত্রে বলা বাহুল্য যে, নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে যে কথাটা বলা হয়, কবিতা নিশ্চয়ই তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু বলার দাবি রাখে। আর এই বেশিটাই কবিকে অমরত্বদান করে। যেমন আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কবি আদ্যনাথ ঘোষ সমকালীন নৈর্ব্যক্তিক প্রণয়-প্রেম আর কামের তাড়নার ছটফটে উল্লম্ফিত কবিতার বদলে সময়ের প্রয়োজনে যে-চেতনাজাগ্রতের আর্তিতে কাব্যরচনা করেছেন, এই জন্য তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তার ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামের কাব্যগ্রন্থের শতেক পাতায় কবি ফুটিয়ে তুলে এনেছেন হৃদয়ের অব্যক্ত ধ্বনি, যা ভালোবাসা আর প্রণয়ের বিদ্যুতে থরথর: তথাপিও তা সম্পূর্ণ নিষ্কাম। প্রণয় আর প্রকৃতির অবোধ মিলনের ইচ্ছা যেমন এখানে প্রবলভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে; তেমনি তিনি হলাহল বিরহ-যন্ত্রণায় প্রণয়ের শুদ্ধ অগ্নিশিখায় দাহ হয়েছেন।

অতঃপর পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়েছেন, স্বর্ণের মতো ধাতুতে।

তার ‘উত্তরের জানালা’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠশেষে পাঠক হৃদয়কে অবশ্যই দারুণভাবে চমকে দেবে, থমকে দেবে; অথবা এও মনে হতে পারে, যেন সময় স্বয়ং থমকে দাঁড়িয়েছে। আর সেই সঙ্গে আমরাও স্নায়ুগ্রস্ত-স্থবির হয়ে পড়েছি। কারণ এই কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেকটি কবিতা যেন প্রকৃতিকে অনুভব-স্পর্শ করার মতো প্রখর অনুভূতিতে থরথর। অন্যদিকে তার ভোরের পাখি কাব্যগ্রন্থে পুনশ্চ নূতন একমাত্রা যেন যোগ হয়েছে। তার এই কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই ব্যক্তিগত বিষণ্ন জগৎ-সংসার, চিরকালের প্রতিবেশী, গ্রহ-নক্ষত্র-পুঞ্জ, জাগতিক শূন্যতা, নদী-নালা, প্রকৃতির অবারিত সমাহার: এমনকি বৃষ্টির রিমিঝিম ফোঁটা, শিশির বিন্দুও এখানে অনায়াসে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে।

পক্ষান্তরের ‘আমি তোমাদেরই একজন’ অথবা ‘আলোর রেখা’ কাব্যগ্রন্থটি যেন এক অজানা মেরুর গল্প। এই কাব্যগ্রন্থে পাঠক-পাঠিকারা যেন প্রকৃতির গভীর-গাঢ় মমতার আরেকটি ভিন্নরূপ দেখতে সক্ষম হবেন এবং কবির সরল সাধু উক্তি যেন ক্রমশ পাঠকের মনে একটি সফল চিত্রকল্পের ছাপ এঁকে দেবে; ফলত পাঠক তার কবিতার অরণ্যে নিজের অজান্তে সেঁধিয়ে যাবেন। এই কাব্যগ্রন্থ অনেকাংশেই ব্যক্তির সুপ্ত-চৈতন্যের অখণ্ড পদাবলি।

কেননা এখানে, পাতায়-পাতায় পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে নস্টালজিয়ার শিশিরেভেজা এক ব্যতিক্রমী রোমান্টিক মেজাজের কল্পনা-অনুভব ও নৈঃসঙ্গতা। আশা-আকাক্সক্ষাও; যা পঙ্ক্তি-পরম্পরায় বোধের কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়েই ধারাবাহিকভাবে পাঠক মননে আলাদা এক বোধের সৃষ্টি করে এবং ব্যক্তিজীবনের বেলাভূমে আছড়ে ফেলে সচেতনতার শুভ্র ঢেউ: যেখানে প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি প্রসঙ্গও কবিতার গাঁথনে সাবলীল ও সৌন্দর্যের অলংকারের বিশিষ্টতা পেয়ে যায় আপনা-আপনি।

একইসঙ্গে তার কবিতায় আবেগের চোরাগর্তগুলো এমন লুকানো যে, তার অনুসন্ধান প্রায় অসম্ভব আবার কখনো-কখনো তা একেবারেই আটপৌরে অথবা নিষ্প্রয়োজন। অন্যদিকে তার কবিতায় ব্যক্তি হৃদয়ের আর্তি-আক্ষেপ জন্ম নিয়েছে এমন সব অভাবিত ভিতের ওপরে, যেখানে জীবনের দহনে পুড়ে খাঁটি হওয়ার সুযোগ খুব কমসংখ্যক মানুষই পেয়েছিল।

সর্বোপরিভাবে তরুণ কবি আদ্যনাথ ঘোষের কাব্যপ্রতিভার সরলীকরণে তাকে নাগরিক চেতনার এক অতন্দ্র প্রহরী হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। বিশেষ করে বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মের কবিরা যেমন বাঙলা কবিতার শরীরে অনবরত লেপন করে যান পুরনো কালের থকথকে পলেস্তরা; তার বদলে কবি আদ্যনাথ ঘোষ এক রকম দুঃসাহসী ভূমিকায় তার সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান নিয়ে সর্বদা পরিচ্ছন্ন হস্তে চেষ্টা করে গেছেন, কবিতার গা থেকে গ্রামীণতার অপবাদ ছেঁটে ফেলতে।

অতঃপর সেয়ানা হস্তে তিনি, সর্বব্যাপী অন্ধকার ও মৃত্যুরগন্ধভরাতুর মনোবিশ্ব ভেদ করে বেরিয়ে আসেন এবং প্রবেশ করেন রৌদ্র-অগ্নি-ব্যর্থতা-সেøাগান-স্বপ্নশূন্যতা-বিক্ষোভ-কোলাহল কবলিত ঝাঁজালো জীবনে।

এসব বিচার-বিশ্লেষণে তরুণ কবি আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবন, একটি চিরচেনা বিশেষ জনপদ, শহর, মানুষ, দেশ এবং তার সমস্ত ক্লেদ, সন্তাপ, নৈঃশব্দ, যন্ত্রণা, বিষাদ, আতঙ্ক, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে উপস্থিত হতে চেয়েছেন। আর বলাই বাহুল্য তিনি সফলভাবে উপস্থাপিত হয়েছেন এবং তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের কবিতায় যে চিত্রকল্প অঙ্কিত হয়েছে; সেখানে যেন এক পার্থিব জগতের প্রতিচ্ছবিই আমরা দেখতে পাই: যা নিরন্তর ক্ষয়ে যাওয়াও বটে।

চমৎকার শিরোনামের ন্যায় তার কাব্যগ্রন্থসমূহের চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন, গুনিন প্রচ্ছদ শিল্পীরা। আর বইয়ের দামও নাগালের মধ্যেই; কাজেই তার কাব্যগ্রন্থসমূহ সর্বস্তরের কবিতাপ্রেমী পাঠকের কাছে সমাদৃত।

আপনার মতামত লিখুন :