কে এই রুহুল আমিন ? ‘জিরো থেকে হিরো’ হওয়ার এক বিস্ময়কর গল্প !
নেপথ্যে চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ বালু উত্তোলন

রুহুল আমিন; সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উচিয়াঘোনা কেরানি বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তিনি ক্ষমতাসিন আওয়ামীলীগের সোনাগাজী উপজেলা সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে অবৈধ বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, দলীয় নেতাকর্মীদের মারধর ও স্থানীয় যুবদল ছাত্রদল নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
রাজনীতিতে উত্থান: রুহুল আমিন ১৯৯৭ সালে উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্য পদে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একই বছর সোনাগাজী ফরিদ সুপারমার্কেটের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফয়েজুল কবিরের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন তিনি। কিন্তু এরপর কখনো সক্রিয়ভাবে আওয়ামী রাজনীতিতে তাকে দেখা যায়নি। ২০০১ সালে সৌদি আরব চলে যান।সেখানে ট্যাক্সি চালাতেন তিনি।
২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০১৩ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে ৪৪ নম্বর কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেও ২০১৮ সালের শুরুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় রুহুল আমিনকে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে জেলা আওয়ামীলীগ। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে তাকে পূর্ণাঙ্গ সভাপতি হিসেবে হিসেবে ঘোষনা করে দলটি।
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সাথে সখ্যতা: রুহুল আমিন আওয়ামী লীগের নেতা হলেও স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল নেতাদের সাথে তার সখ্যতা বেশি ছিল। উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম, চরচান্দিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াধন, ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটক দুলাল ওরফে বাটা দুলাল, ইয়াবা বিক্রেতা হেলাল, সিরাজ ওরফে সিরাজ ডাকাতসহ বেশ কয়েকজন বিএনপি অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ছিলো রুহুল আমিনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। সরকার বিরোধী নাশকতা কর্মকান্ডে এসব নেতারা জড়িত হলেও আওয়ামীলীগ নেতা রুহুল আমিনের ইশারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতো না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অবৈধ বালু উত্তোলন: ফেনী নদীর মুহুরী প্রকল্প অংশের একটি বালুমহাল ও ছোট ফেনী নদীর সাহেবের ঘাট এলাকায় আরেকটি বড় বালুমহাল সাবেক সংসদ সদস্য রহিম উল্যাহর লোকজন নিয়ন্ত্রণ করতো। তা সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রুহুল আমিন দখল করে নেন। এখনো এ দুটি বালুমহালে কয়েক কোটি টাকার বালু রয়েছে বলে দলীয় স‚ত্র জানিয়েছেন।
ইউএনও ও এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে মামলা: আওয়ামীলীগ নেতা রুহুল আমিনের অবৈধ বালুমহালে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করায় ক্ষিপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট সোনাগাজীর ইউএনও সোহেল পারভেজ ও সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) শাহরিন ফেরদৌসীর বিরুদ্ধে তিনি আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালতের বিচারিক হাকিম জাকির হোসেনের মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। পরে প্রশাসন ও রুহুল আমিনের মাঝে সমঝোতা হয়ে মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়।
নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের উপর হামলা: রুহুল আমিনের অনুগত না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য আবুল কালাম বাহারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তার ক্যাডার বাহিনী। এছাড়া সোনাগাজী সদর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা স্বপন, চরদরবেশ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ, মতিগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটনসহ অনেকেই বিভিন্ন সময় রুহুল আমিনের ক্যাডার বাহিনীর হাতে হামলা-মারধরের শিকার হয়েছেন বলে দলীয় নির্ভর সূত্র জানায়।
চাঁদাবাজির অভিযোগ: সোনাগাজী পৌরসভায় সিএনজি চালিত অটোরিক্সার বিভিন্ন স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করতো রুহুল আমিনের সহযোগিরা। এছাড়া ব্যাটারী চালিত রিক্সাসহ সোনাগাজীমুখি পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করতো।
জামায়াত নেতা সিরাজের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা: ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামীয়া ফাজিল মাদ্রাসার বরখাস্থকৃত অধ্যক্ষ ও বহিষ্কৃত জামায়াত নেতা সিরাজ উদদৌলার অনিয়ম দুর্ণীতি, যৌন হয়রানিসহ সকল অন্যায় কাজের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা রুহুল আমিন। সিরাজকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সরাসরি সহযোগিতা করে আসছিলেন। কিছুদিন পূর্বে মাদ্রাসার বাতিলকৃত গভর্নিং বডির নির্বাচনে সহ-সভাপতি পদে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে কায়দা করে নির্বাচিত করেন সিরাজ।
স্থানীয় একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, অধ্যক্ষ সিরাজকে রক্ষা করতে যৌন হয়রানির একটি ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও মাদ্রাসা গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও গভর্নিং বডির শিক্ষানুরাগী সদস্য কাউন্সিলর মকসুদুল আলমসহ যুবলীগ-ছাত্রলীগের একটি সংঘবদ্ধ দল। এর বিনিময়ে তারা অধ্যক্ষ সিরাজ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখান থেকেই আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের সাথে অধ্যক্ষের আরো ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
এদিকে গত ২৭ মার্চ নিজ কক্ষে ডেকে শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। বিষয়টি জানাজানি হলে মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক- শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয়রা অধ্যক্ষ সিরাজকে আটক করে রাখলে অবস্থা বেগতিক দেখে সিরাজকে কৌশলে রক্ষা করার জন্য পুলিশে সোপর্দ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন। এ পরিস্থিতিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকনের নেতৃত্বে ভূক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়রা প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে সিরাজকে কারাগারে পাঠানো হয়।
অপরদিকে ৩০ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তির দাবিতে শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সোনাগাজী জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সমাবেশ পালন করে তার অনুসারীরা। এসময় নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামিম ও জাবেদসহ কয়েকজন ছাত্রী বক্তব্য রাখেন। এ কর্মসূচি পালনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন রুহুল আমিনের অনুসারী কাউন্সিলর মকসুদুল আলম।
নুসরাত হত্যাকান্ডে জড়িত: আলোচিত নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকান্ডে জড়িত আসামীদের জবানবন্দিতে আওয়ামীলীগ নেতা রুহুল আমিনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে। জবানবন্দিতে শাহাদাত হোসেন শামীম বলেছে, আগুন দিয়ে সে নিচে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে বিষয়টি উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে মোবাইল ফোনে জানালে তিনি শামিমকে বলেন, আমি জানি। তোমরা চলে যাও।
গ্রেফতার ও রিমান্ডঃ নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের মামলায় শুক্রবার বিকালে সোনাগাজী পৌরসভাস্থ তাকিয়া রোডের বাসা থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে আটক করে পুলিশ। শনিবার বিকাল ৫ টার দিকে ফেনীর সিনিয়র বিচারিক হাকিম সরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে রুহুল আমিনকে গ্রেফতার দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পিবিআই।পরে সন্ধ্যায় এক আদেশে আদালত রুহুল আমিনের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
জিএসনিউজ/এমএইচএম/এমএআই