জেনে নিন যা ঘটেছিল গাজীপুর সিটি নির্বাচনে

GS News 24GS News 24
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ১২:০২ পিএম, ২৮ জুন ২০১৮

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ>>>

বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, সমর্থকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ৯টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হওয়া ছাড়া গাজীপুরে অনেকটা নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছে। নির্বাচনে ভোটের শুরুতে ভোট কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। অন্যদিকে জনগণের রায়কে মেনে নেয়ার কথা বলেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম।

 

 

 

কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভোট গ্রহণ। সকালে কিছু সময় বৃষ্টি হওয়ায় কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অনেকটাই কম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভোটার উপস্থিতি ও। বিভিন্ন হালকা যানবাহনে চড়ে কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন অনেকে।

 

সকাল ৮টা ১২ মিনিটে টঙ্গীর আউচপাড়ায় বশির উদ্দিন উদয়ন একাডেমী ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন হাসান উদ্দিন সরকার। এ সময় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট হবে না এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপি মেয়র প্রার্থী বলেন, সকাল থেকেই বিএনপির এজেন্টদেরকে কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া শুরু হয়েছে। তারপর সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পরই একের পর এক শুরু হয় অনিয়ম ও কারচুপি। তবে নির্বাচনের আমি আছি, থাকব। এই নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। জনগণ যদি ফলাফল মেনে নেয়, তাহলে আমিও মেনে নেব।

 

তিনি আরও বলেন, সাদা গাড়িতে আমাদের নেতা-কর্মীদের তুলে নিয়ে যাচ্ছেন প্রশাসন। যে কৌশলে ভোট নেয়া হচ্ছে, তাতে কতো শতাংশ ভোট হয় তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তারপরও লড়ে যাব। অনিয়ম, কেন্দ্র দখল ও জালভোটের অভিযোগ এনে দুপুর ১টার দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। জয়দেবপুরে গাজীপুর জেলা বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি করেন তিনি। পরে ভোট বন্ধের দাবি সম্বলিত লিখিত অভিযোগ নিয়ে ধানের শীষের প্রার্থী বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান।

 

আর সকাল ৯টা ১৪ মিনিটে নিজ গ্রাম কানাইয়া এলাকায় কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর। এ সময় তিনি বলেন, জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। তারপরও জনগণ যে রায় দেবে তা মেনে নেব। সত্যকে গ্রহণ করার শক্তি আমার আছে। তার নির্বাচনী কর্মীদেরও জনগণের রায় মেনে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

 

 

এ সময় তিনি বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা শুরু থেকেই মিথ্যাচার করছেন। কোথাও কোনো বাধা দেয়া হচ্ছে না। ভোটাররা নিজ দায়িত্বে ভোট দিতে আসছেন। গাজীপুরের মানুষ তাদের সন্তান হিসেবে, সেবক হিসেবে আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করবেন।

 

 

নৌকায় সীল মারা ব্যালট সরবরাহ: ৩৭ নং ওয়ার্ডের মির্জা ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্কুল ভোটকেন্দ্রের একটি বুথে ভোট শুরুর আগেই নৌকার সমর্থকরা ব্যালটের একটি বইয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে রাখে। পরে ভোটাররা ভোট দিতে এলে তাদেরকে সীল মারা ব্যালট দেওয়া হয়।

 

 

বেলা ১২টায় ঐ কেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের বাইরে ভোটারের লম্বা লাইন। দীর্ঘ সময় লাইনে অপেক্ষার পর একটি বুথের ভোট দিতে ঢুকেন এক তরুণী। যথারীতি তাকে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর ব্যালট পেপার দেয়া হয়। মেয়র প্রার্থীর ব্যালট নিতে গেলে সেখানে থাকা কয়েকজন জানায়, ‘মেয়রে ভোট দেয়া লাগবে না। এ ভোট তারা নিজেরাই দিয়ে দিচ্ছে।’

 

 

তাকে আরো জানানো হয়, তার ব্যালটে সিলমারা হয়ে গেছে। পরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বের হয়ে আসেন প্রথমবারের মতো ভোট দিতে যাওয়া এ নারী।

 

এই নারী আরো জানান, ওই স্কুলের দুই তলার কক্ষগুলোতে জাল ভোটের এসব ঘটনা ঘটছে। তারা মেয়র প্রার্থীর ব্যালটে আগে থেকেই নৌকা প্রতীকে সিল মেরে রেখেছে। কোন ভোটার গেলে তাকে দুটি ব্যালট পেপার দিচ্ছে। বাকি মেয়রের ভোট তারা নিজেরা দিচ্ছে। একই ওয়ার্ডে পাশ্ববর্তী হাজী আবদুল লতিফ প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই অবস্থা দেখা যায়।

 

 

দুপুর দেড়টার দিকে জানা যায়, এ কেন্দ্রটিতে নৌকার পাশপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রতীক ঠেলাগাড়িতেও সিলমারা রয়েছে। সেখানে শুধুমাত্র একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকেই ভোট দিতে পারছেন ভোটাররা।

 

 

ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে নৌকায় সিল: শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকরা জোরে করে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারে। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে কেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ করে বিএনপি সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থী হান্নান মিয়া হান্নুর সমর্থকরা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়।

 

 

ওই কেন্দ্রের ২০১ নং বুথের ভোটার মির মোহাম্মদ মোফাজ্জল বলেন, আমি বুথে প্রবেশ করার পরে ৭/৮ জন লোক এসে আমার কাছ থেকে ব্যালট ছিনিয়ে নেয়। এ সময় তারা বুথে থাকা অন্য ব্যালট নিয়ে তারা নৌকা প্রতীকে সিল মারতে থাকে।

 

 

ঘটনার পর ওই বুথে গিয়ে দেখা যায়, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের সামনে রাখা মেয়র প্রার্থীর ব্যালটের মূল বই শেষ। অপরদিকে কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত নারী আসনের ব্যালট গিয়েছে অর্ধেক। ওই কেন্দ্রের ৬টি বুথে বিএনপির কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি।

 

সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ২০৩ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও মেয়র ও কাউন্সলর প্রার্থীর ব্যালট শেষ। তবে নারী কাউন্সিলরের ব্যালট শেষ হয় ৮১টা।

 

ওই বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুস সালাম বলেন, চারপাশে ঘিরে আধা ঘণ্টা ধরে ভোট কেটে নেয়া হয়। পাশের বুথ ২০৫ নম্বরেও একই ঘটনা ঘটে। এই বুথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট শাহীন রেজা নিজেও তার প্রার্থীর পক্ষে ব্যালটে সিল মারেন। সামনাসামনি এ অভিযোগ করেন নৌকার এজেন্ট মো. মিজানুর রহমান লিটন এবং অপর কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট আব্দুল করিম। ২০৬ নং বুথে দেখা গেছে, মেয়র প্রার্থীর ব্যালট ১০৬টা ব্যবহার হলেও কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর ব্যালট গেছে ৯১টি।

 

এসব বিষয়ে গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাসেল মিয়া বলেন, আমরা অভিযোগগুলো যাছাই করে দেখছি। এটা প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব। তিনি ব্যবস্থা নেবেন। প্রিসাইডিং অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে সমস্যা জেনে নিচ্ছি। কিছু লোক জাল ভোট দিতে আসছিলো পোলিং এজেন্টরা তাদের চিহ্নিত করার পরে একটু সমস্যা হয়েছে। আমরা ব্যবস্থা নেব।

 

একই ঘটনা ঘটে জয়দেবপুরে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের মদিনাতুল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসা কেন্দ্রেও। জোর করে ঢুকে নৌকার পক্ষে সিল মারে ২০ থেকে ৩০ জন যুবক। এ ঘটনা ঘটায় সেখানে আধঘণ্টার মতো ভোট নেওয়া বন্ধ ছিল।

 

ওই কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এখলাসুর রহমান বলেন, ২০ থেকে ৩০ জন যুবক অতর্কিতে কেন্দ্রের তিনতলার একটি বুথে ঢুকে তাঁর কাছ থেকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেন। এরপর দ্রুত নৌকা মার্কায় সিল মেরে বাক্সে ভর্তি করেন। এ ঘটনার পর আধঘণ্টার মতো ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখতে হয়। ঘটনাটি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জানানো হয়।

 

জানতে চাইলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। তিনি ভোট চালু রাখতে বলেছেন। পরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।

 

৯ কেন্দ্রের ভোট স্থগিত : গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে জালিয়াতির ঘটনায় ৯টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে। স্থগিত কেন্দ্র গুলো হলো- খরতৈল মনসুর আলী আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্র-১ (নং-৩৭২), খরতৈল মনসুর আলী আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ (নং ৩৭৩), হাজী পিয়ার আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র (নং-৩৮১), জাহান পাবলিক দত্তপাড়া টঙ্গী কেন্দ্র (নং-৩৪২), ভোগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র (নং-৯৮), কুনিয়া হাজী আব্দুল লতিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র-১ (নং-২৪৩), কুনিয়া হাজী আব্দুল লতিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ (নং-২৪৪), মেশিন টুলস উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ (নং-১৬১) এবং বিন্দান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পূবাইল কেন্দ্র (নং ২৭৪)।

 

সহকারী রির্টানিং অফিসার তারিফুজ্জামান বলেন, কেন্দ্রগুলোর সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং অফিসার ইসির সঙ্গে পরামর্শ করে বিধি মোতাবেক ভোট গ্রহণ স্থগিত করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে তালিকা পাঠিয়েছেন। এসব কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ২৩ হাজার ৯৩৫ জন।

সুত্রঃ বিডি২৪ লাইভ ডটকম

আপনার মতামত লিখুন :