নুসরাতকে ছাদে ডেকে নেয় পপি, আগুন দেয় জাবেদ

MD Aminul IslamMD Aminul Islam
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৫:১৩ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০১৯
ফাইল ছবি

গতকাল রোববার বিকেল ২টা ৫৫ মিনিট থেকে দিবাগত গভীর রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত প্রায় ১০ ঘণ্টা নুসরাত জাহান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের ‘ঘনিষ্ঠ’ নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসেনের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।

এর আগে এ দুজনকে পিবিআই সদর দপ্তর ঢাকা থেকে মাইক্রোবাসে করে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ফেনীতে নিয়ে আসা হয়। আইন অনুযায়ী, গাড়ি থেকে নীল কাপড়ে তাদের মুখ ঢেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়।

আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর দুই আসামিকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। রাত দেড়টার দিকে গণমাধ্যমের সামনে আসেন পিবিআইর স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন উইংয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহেরুল হক চৌহান। তাঁর সঙ্গে পিবিআই ফেনী ও সদর দপ্তরের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

গ্রেপ্তার করা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে দেওয়া তাদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আর সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্যের মধ্য দিয়ে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ‘একটা সার্বিক চিত্র’ স্পষ্ট করে এনেছে এ ঘটনার তদন্তে থাকা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র চার দিনের মাথায় পিবিআই নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত চারজনের মধ্যে দুজনসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার এবং কার নির্দেশে, কারা, কীভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে; তার ‘মূল রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছে’ বলে দাবি করেছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহেরুল হক চৌহান বলেন, ‘গত ১০ এপ্রিল পিবিআই এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে। চার দিনের মধ্যে আমরা ঘটনার যারা মূল নায়ক, ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে, তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করেছি। পিবিআই সদর দপ্তর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তের ভিত্তিতে শুধু গ্রেপ্তারে সহায়তা করেছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা আইনের মধ্য থেকেই তাদের মধ্যে দুজনকে আদালতে উপস্থাপন করেছেন। আদালত দীর্ঘ সময় ধরে তাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এ দুজন আসামি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সিআরপিসির ১৬৪ ধারায় আদালতের কাছে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে।

বক্তব্যে পুরো বিষয়টি তারা খোলাসা করেছে। একেবারে কীভাবে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে, কারা ঘটিয়েছে, কী আঙ্গিকে ঘটিয়েছে—এর বিস্তারিত বিবরণ আমি এখানে দেব না। বাট বিষয়গুলো এখানে এসেছে। আপনারা দ্রুতই বিষয়গুলো জানবেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা বা এখানে পিবিআইর যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরা সংশ্লিষ্ট সময়ে বিষয়গুলো অবগত করবেন।

এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরো বলেন, ‘তারা অপরাধ স্বীকার করেছে। তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তারা সরাসরি এখানে জড়িত ছিল কয়েকজন। পরিকল্পনা অংশগ্রহণ করেছে। জেলাখানা বন্দি অধ্যক্ষের কাছ থেকে হুকুম পেয়েছে। এ বিষয়গুলো মূলত এসেছে।

হত্যাকাণ্ডে কতজন সংশ্লিষ্ট ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে তাবেরুল হক চৌহান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা ১৩ জনের কথাই বলছি। কিন্তু আরো অনেকের নাম এসেছে। আমরা একজনের বক্তব্য যাচাই-বাছাই না করে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করতে পারি না।

যে চারজন সরাসরি নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছে, তারা কি গ্রেপ্তার হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘চারজনের সকলকে আমরা গ্রেপ্তার করতে পারিনি। আমার মনে হয়, দুজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আর দুজনকে গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যেকোনো সময় আমরা আপনাদের একটি ভালো নিউজ দিতে পারব।

পিবিআইর অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে মূল ঘটনা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিবিআইর এই সূত্রটি দাবি করে, ‘নুসরাতের ওপর হামলার সময় নুর উদ্দিন হামলাকারীদের নিরাপত্তা ও হামলার পর নিরাপদে বের হয়ে যাওয়াটি নিশ্চিত করতে স্কুলগেটে অবস্থান করেছিল। আর শাহাদাত হোসেন শামীম বাজার থেকে বোরকা ও পলিথিনে করে এক লিটার কেরোসিন সংগ্রহ করে মাদ্রাসায় নিয়ে আসে।’

‘ঘটনার সময় ওড়না দিয়ে নুসরাতের দুই হাত পেছন থেকে ও মুখ চেপে ধরে কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এবং নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া হয়। নুসরাতের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয় জাবেদ।’

সূত্রটি আরো দাবি করে, ‘এ ছাড়া নুসরাতকে পরীক্ষার হল থেকে ছাদে ডেকে নেয় পপি। নুসরাতকে বলা হয়েছিল, তার বান্ধবীকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। ছাদে তখন অপেক্ষায় ছিল শামীম, জাবেদ, শম্পাসহ আরো একজন।’

নুসরাত জাহান রাফি এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মাওলানা এস এম মুসার মেয়ে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে নুসরাত তৃতীয়।

গত ৬ এপ্রিল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসা ভবনের ছাদে দুর্বৃত্তরা তাঁর গায়ে আগুন দেয়। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ফেনী সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। পরে এখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার রাতে তিনি মারা যান।

এর আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহানের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। নুসরাত বিষয়টি বাসায় জানালে তাঁদের মা সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সোনাগাজী থানা পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে প্রধান আসামি করে আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো চার/পাঁচজনকে আসামি করে নুসরাতের ভাই নোমান মামলা দায়ের করেন।

এরপর গত বৃস্পতিবার রাতে ময়মনসিংহ ভালুকা থেকে নুর উদ্দিন, পরদিন শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে শাহাদাত হোসেন শামীমকে গ্রেফতার করে পিবিআই। নুর উদ্দিন নুসরাত হত্যা মামলার দুই নম্বর এবং শাহাদাত হোসেন শামীম তিন নম্বর আসামি।

এ মামলায় এজাহারনামীয় সাতজনসহ এ পর্যন্ত মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাও রয়েছেন। বিভিন্ন মেয়াদে পুলিশ রিমান্ডে নিয়েছে ১১ জনকে।

অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা ও জাবেদ সাত দিন করে এবং অন্যদের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এজাহারভুক্ত এক আসামি হাফেজ আবদুল কাদের এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।

জিএসনিউজ/এমএইচএম/এমএআই

আপনার মতামত লিখুন :