খুলনার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বল প্রয়োগ ও অনিয়মের তদন্ত চায় যুক্তরাষ্ট্র

অনলাইন ডেস্ক :>>>
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভাঙচুর ও অনিয়মের ঘটনাগুলোর স্বচ্ছ তদন্ত চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য তদন্তটি জরুরি উল্লেখ করে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানান। খুলনার নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনায় ‘হতাশা’ ব্যক্ত করলেও মার্কিন দূত নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হওয়ায় প্রার্থীদের ও ধন্যবাদ জানান।
গতকাল বুধবার বিকালে সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে রাষ্ট্রদূত এ নিয়ে কথা বলেন। ওই নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেণ করেছে। ঢাকা সফররত মার্কিন দাতব্য সংস্থা ইউএসএআইডির প্রশাসক মার্ক গ্রীনকে নিয়ে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বুধবার বিকালে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। ঘন্টাব্যাপী বৈঠক শেষে গ্রীন ও বার্নিকাট উভয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকরা পর্যবেক হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন জানতে চান। জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, নির্বাচনটি সবার অংশগ্রহণে হওয়ায় এ জন্য আমি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের ধন্যবাদ জানাই। তবে ওই ভোটে যে বলপ্রয়োগ হয়েছে, ভোটারদের বাধা দান, ভাঙচুর এবং অনিয়মের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার স্বচ্ছ তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে প্রতি আহবান জানাচ্ছি। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য এটি করা অত্যন্ত জরুরি।
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পু এক টুইট বার্তায় জানান, ওই আলোচনায় অংশ নেয়া জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছেন। এছাড়া দেশের সর্বজনীন মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের এক শুনানিতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। মানবাধিকার কাউন্সিলে থার্ড সাইকেল ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউতে (ইউপিআর) বাংলাদেশ সরকার দেশের মানবাধিকার বিষয়ে যে কান্ট্রি পেপার বা অবস্থানপত্র উত্থাপন করেছে তার ওপর আলোচনা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শেখ হাসিনার মানবিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বলে সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। সেখানে বলপূর্বক গুম, বাল্যবিবাহ, মৃত্যুদন্ড, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর তরফে বিভিন্ন সুপারিশ ছিল। সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। সোমবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ওই শুনানি হয়। তবে সেখানে দেশের সর্বজনীন মানবাধিকার বিষয়ে কোন দেশ কি অবভারভেশন বা রিজারভেশন দিয়েছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তার কোনো উল্লেখ ছিল না। জাতিসংঘের তরফেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু করা হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, শুনানিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। প্রতিনিধি দলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক, জেনেভায় নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত শামীম আহসানসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পর্যালোচনায় র্যাপোর্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করে রুয়ান্ডা, আফগানিস্তান ও ইউক্রেন। ইউপিআর ওয়ার্কিং গ্রুপের মাধ্যমে ৭ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত বাংলাদেশসহ ১৪টি রাষ্ট্রের পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম এবং ২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইউপিআর পর্যালোচনা করা হয়েছিল। সূচনা বক্তব্যে আইনমন্ত্রী মানবাধিকার সুরা ও আর্থ-সামাজিক েেত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে অগ্রগতির কথা তুলে ধরেন। শুনানিতে অংশ নেয়া ১০৭ দেশ মানবাধিকার রায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ও প্রত্যয়ের প্রশংসা করে। আরো বিভিন্ন েেত্র এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে তারা সুপারিশ করেছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রা, বাল্য বিবাহ বন্ধ, মানবপাচার বন্ধ, জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সমতা বৃদ্ধি এবং বৈষম্য দূর করতে পদপে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে অগ্রগতির কথাও জানিয়েছে তারা। আগামী ১৭ মে শুনানির ওপর বাংলাদেশের ইউপিআর প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে।
এদিকে জেনেভা ডেটলাইনে প্রকাশিত এক আগাম রিপোর্টে বাংলাদেশ সরকারের জমা দেয়া মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যার ওপর ভিত্তি করে গতকালের পর্যালোচনা হয়েছে। সেখানে সরকারের চোখে মানবাধিকারের েেত্র বাংলাদেশের চমৎকার অগ্রগতি হয়েছে। তবে জাতিসংঘে বেসরকারি প্রতিবেদনে বিপরীত চিত্র ফুটে উঠেছে বলে জানানো হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না তা নিয়েও কয়েকটি দেশের জিজ্ঞাসা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে মতা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকারের েেত্র চমৎকার অগ্রগতি করেছে বলে জাতিসংঘকে জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পেশ করা প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের আগাম উত্থাপিত প্রশ্নমালায় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, বিরোধীদলীয় সদস্যদের গ্রেফতার, মতপ্রকাশের অধিকার সংকোচন, ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নারী ও শিশুর নিরাপত্তাহীনতা এবং বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের যেসব পরিসংখ্যান ও তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা একেবারেই ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। ২০১৩ সালের ইফপিআর-এ বাংলাদেশের জন্য ১৯১টি সুপারিশ গৃহীত হয়েছিল। একই বিষয়ে অনেকগুলো সুপারিশেরও নজির রয়েছে।
সরকারের পেশ করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ইফপিআরের যেসব সুপারিশ বাংলাদেশ গ্রহণ করেছিল, সেগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সরকার সেগুলোর প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। যেসব েেত্র ঘাটতি রয়ে গেছে সেগুলো বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক শরিকদের সহযোগিতায় আরও জোরালো উদ্যোগ নেয়ার কথাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের গৃহীত পদপেগুলোর মধ্যে প্রতিবন্ধীদের সুরা আইন, খাদ্য নিরাপত্তা আইন, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, শিশু আইন, বাল্যবিবাহ নিরোধক আইনসহ ২০১৩ থেকে ২০১৭ সময়ে প্রণীত অধিকারবিষয়ক আইন এবং কর্মেেত্র নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যনীতি, সম্প্রচারনীতি, পুষ্টিনীতি, ওষুধনীতি, অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গৃহীত নীতিগুলোর কথা সরকারি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। ধর্মপালনের অধিকার-বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার এবং শরণার্থী বিষয়ক র্যাপোর্টিয়ারের বাংলাদেশে সফরের কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার কথাও সরকারের প থেকে জানানো হয়েছে। তবে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পেশ করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বিগত ইউপিআরের সুপারিশমালা গ্রহণ করা সত্ত্বেও বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এবং যথেচ্ছ গ্রেফতারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একটি প্রতিবেদনে ২০১৩ সালের মে থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৮৪৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যা, ৩০০ জন গুম এবং ৪৮ জনের নির্যাতনে মৃত্যুর রেকর্ডের কথা বলা হয়েছে। ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন তৈরির পরও পদ্ধতিগতভাবে নির্যাতনের প্রচলন ব্যাপক বলে তারা উল্লেখ করেছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই সময়ে ৪৫ জন গুম হওয়ার কথা জানিয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গত নির্বাচন এবং ২০১৫ সালে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতা এবং বেআইনি গ্রেফতার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ঘটনাগুলো তদন্তের কথা বলেছে। একই সঙ্গে কমিশন নির্যাতন নিরোধক আইন কার্যকরভাবে অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্টস কাউন্সিল এসব গুমে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর জড়িত থাকার কথা বলেছে।