আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে অবৈধ ভাবে ফেনি নদী থেকে পানি তুলে নিচ্ছে ভারত

GS News 24GS News 24
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০২:১৯ পিএম, ০৫ মার্চ ২০১৮

আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে গায়ের জোরে অবৈধ ভাবে ফেনি নদী থেকে পানি তুলে নিচ্ছে ভারত। দেশটির দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমার ১৭টি সীমান্ত পয়েন্টের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে বিদ্যুৎ চালিত উচ্চ ক্ষমতার প্রায় ৩৪টি লো-লিফট পাম্পের মাধ্যমে ফেনি নদীর পানি তুলে নেয়া হচ্ছে। এতে হুমকিতে পড়ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘মুহুরি প্রজেক্ট’। খরা মৌসুম আসার আগেই ফেনি নদীর আশপাশের ২৫টি খাল-ছরা এখনই শুকিয়ে গেছে। পানি কমে যাওয়ায় সেচ তো দূরের কথা আশপাশে পরিবেশ বিপর্যয় ও জীববৈচিত্র পড়ে গেছে হুমকির মুখে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে ফেনি নদীর প্রবাহ থেকে ৩০-৩৫ গজ দূরে পা¤প হাউস স্থাপন করে পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জেলার ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলারও অন্তত ১০টি ইউনিয়নে ফসলের মাঠ পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। ফেনী নদীর দৈর্ঘ ১১৬ কিলোমিটার। নদীর প্রায় ৭০ কিলোমিটার জুড়ে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত। খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম পাশাপাশি এলাকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুত্রে জানা যায় শুল্ক মৌসুমে ফেনী নদীতে পানি থাকে সর্বোচ্চ ২৫০ কিউসেক। অথচ ভারত নিতে চায় এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি।

শুধু তাই নয় ফেনী নদীতে বাঁধ দিয়ে এর আশপাশের প্রায় এক হাজার ৭০০ একর জমি দখল করে রেখেছে প্রতিবেশি দেশটি। এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির গুইমারা সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম জাহিদুর রশীদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ভারত ফেনী নদী থেকে ৩৪টি উচ্চ ক্ষমতাস¤পন্ন পা¤প বসিয়ে পানি তুলে নিচ্ছে। দুই দেশের সচিব এবং ডিজি পর্যায়ে বৈঠকে পা¤পগুলো তুলে নিতে বিএসএফকে অনুরোধ করে চিঠি দেয়া হয়েছে।

মাটিরাঙা উপজেলা চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম জানান ভারতের দখলে থাকা বিভিন্ন সীমান্তের বাংলাদেশের ভূমি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসালংয়ের এক হাজার ৭০০ একর ভূমিও উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। মাটিরাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ শামছুল হক দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় ভারত গোপনে ফেনী নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে নেওয়ার চক্রান্ত করছে।

চট্টগ্রামের মীরসরাই আর ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলা মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ বাংলাদেশেই উৎপত্তি হওয়া ফেনী নদীতে ১৫৬ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাঁধ দিয়েছে বাংলাদেশ। অথচ কোন চুক্তি ছাড়া, কোন প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই এ ফেনী নদী থেকে ভারত চুরি করছে পানি। অবিরাম পানি চুরির ফলে এখন শুষ্ক মৌসুমে অবশিষ্ট পানি শুকিয়ে নদীর তলাই দেখা যাচ্ছে। মীরসরাই, ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজীর অর্ধশত খাল ছরাও গেছে শুকিয়ে।

১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে দুই দেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ফেনী নদীর নাম নেই। পাউবো ও বিজিবির দফায় আন্তঃমন্ত্রণালয় উদ্যোগের পরও হচ্ছে না কোন ফল। ফেনী নদী থেকে বয়ে আসা মীরসরাই উপজেলার ১নং করেরহাট, ২নং হিঙ্গুলী, ৩নং জোরারগঞ্জ, ৪নং ধূম ও ৫নং ওচমানপুর ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি খাল ছরা এখন শুকিয়ে সেচ তো দূরের কথা পরিবেশ রক্ষা ও হুমকিতে রয়েছে। একইভাবে ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলারও অন্তত ১০টি ইউনিয়নে ফসলের মাঠ পানিশূন্য হয়ে আছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ গত ৩০ বছরের গঙ্গা চুক্তির ২০ বছরেও প্রয়োজনীয় পানি দেয়নি ভারত।

দু’দেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির ভাগবাটোয়ারা এখনো মীমাংসা হয়নি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের বাহানায় দীর্ঘদিন থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তিস্তা চুক্তি। আর এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফেনী নদীর পানি গোপনে তুলে নিচ্ছে, আবার এ নিয়ে মাথা ঘামানোর পর শুধুমাত্র এই নদীর পানি নিতে চুক্তি করতে চায়। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমার ১৭টি সীমান্ত পয়েন্টের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে বিদ্যুৎ চালিত উচ্চ ক্ষমতার প্রায় ৩৪টি লো-লিফট পা¤প স্থাপন করে মাটির নিচে নদী তীরের কাছে শতাধিক কিউসেক পানি গোপনে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে আপত্তি জানানো হলেও কর্ণপাত করছে না ভারত। শুল্ক মৌসুমে ফেনী নদীতে সর্বোচ্চ ২৫০ কিউসেক পানি থাকে। তা থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গোপনে নোম্যান্সল্যান্ড এই নদীর তীরে গোপনে পাকা স্থাপনা ও টিনের বেড়া দিয়ে তারা ৩৪টি পা¤প বসিয়েছে এবং এসব পা¤প মেশিনে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি সিআই পাইপ লাগানো হয়েছে।

এসব মেশিন দিয়ে গোপনে নদী থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল যা আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন নীতির চরম লঙ্ঘন। এর আগে ২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশের তরফ থেকে পানি উত্তোলনের বিষয়ে বিরোধিতা করা হলে তা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। পরে গোপনে আবার পানি উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। অপরদিকে ফেনী নদীতে বাঁধ দিয়ে এর আশপাশের প্রায় এক হাজার ৭০০ একর জমি দখল করে রেখেছে ভারত। এদিকে ভারত ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে পড়ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘মুহুরি প্রজেক্ট’। বিশেষ করে নদীতে পানি কমে গেলে শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায় চাষাবাদ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ফেনী নদী থেকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি নিতে চাইছে ভারত।

বিষয়টি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চুক্তি হওয়ার আগেই নিয়মিত পানি তুলে নিচ্ছে তারা। ফেনী নদী ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে এ নদী রয়েছে প্রায় ৭০ কিলোমিটার জুড়ে। খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম পাশাপাশি এলাকা। ওই এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, নদীর প্রবাহ থেকে ৩০-৩৫ গজ দূরে পা¤প হাউস স্থাপন করে নদী থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পা¤প হাউস থেকে নদীর পানির ধারা পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে ৭-৮ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ লাগিয়ে পানি তুলে সাবরুম মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করছে ভারত। দক্ষিণ ত্রিপুরার অমরপুরের শিলাছড়ি থেকে সাবরুমের আমলীঘাট পর্যন্ত পা¤প হাউসগুলো স্থাপিত হয়েছে। সেগুলোকে বেশিরভাগ বাংলাদেশের রামগড়ের সীমান্তবর্তী লাচারিপাড়া থেকে মিরসরাইয়ের অলিনগরের বিপরীত দিকে অবস্থিত। বাংলাদেশের বাঁধা উপেক্ষা করে বছরের পর বছর পানি নিয়ে যাচ্ছে ভারত।

এতে বাংলাদেশের ফেনী, রামগড় ও মিরসরাইয়ের সীমান্তবর্তী এলাকার হাজার হাজার একর জমিতে পানির অভাবে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শত শত ফলের বাগান। এ কারণে পথে বসার উপক্রম হয়েছে এলাকার কৃষকদের। একইভাবে পানির অভাবে হুমকির মুখে পড়ছে ফেনীর ‘মুহুরি প্রজেক্ট’ও। শুষ্ক মৌসুমে পানি নিয়ে যাওয়ায় ধু-ধু চরে পরিণত হচ্ছে ফেনী নদী। পাউবো চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের জন্য ভারতকে কোন অনুমতি দেয়া হয়নি। বিষয়টি নি®পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নদী থেকে পানি না নিতে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে।’

আপনার মতামত লিখুন :