আমরা সবাই সবসময় সাহসী হয়ে উঠতে পারি না

মেহরাব হোসেন মেহেদীমেহরাব হোসেন মেহেদী
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৭:৩৯ পিএম, ০৪ আগস্ট ২০২৫

আমরাও ভয় পাই, আমরাও কখনো কখনো চুপ থাকি। তবু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন অন্যায়ের মুখে দাঁড়াতে হয়_ কলম দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে।

আমরা যারা ফেনী জনপদের মানুষ_ রাজপথে, কলমে কিংবা স্ক্রিনে প্রতিবাদের চেষ্টা করি_ আমরা জানি, সাহস একা জন্মায় না। সাহস গড়ে ওঠে সংগ্রামের ভিতর দিয়ে, একে অন্যের হাত ধরে।

এই সাহসিকতার একটি নাম_ রফিকুল ইসলাম। তিনি আমাদের একজন। আমাদের অগ্রজ, আমাদের সহযোদ্ধা। তিনি কেবল একজন সাংবাদিক ছিলেন না—তিনি চলমান ইতিহাসের এক প্রত্যক্ষ অংশ।

দৈনিক আমার দেশ-এর শুরুতে ফেনী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেই পত্রিকাটি ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থানের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রফিক ভাই থেমে যাননি। বাংলাভিশন-এর সূচনালগ্ন থেকে মাঠে থেকে নির্ভীকভাবে রিপোর্টিং করে গেছেন। দুর্বৃত্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছেন। এই রাষ্ট্রে সত্য বলাটাই যেন তাঁর ‘অপরাধ’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

২০০৭ সালের এক-এগারোর সময় জেনারেল মাসুদের বিরুদ্ধে ফেনীতে যে নাগরিক প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন রফিকুল ইসলাম। আমরা অনেকেই আতঙ্কে চুপ ছিলাম, কিন্তু তিনি সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন।

এই সাহসিকতা ঢাকার বড় মিডিয়ার পাতায় লেখা না থাকলেও আমরা যারা সেই লড়াইয়ের অংশ ছিলাম, আমরা জানি। ফেনী-৩ আসনে সেই খলনায়ককে প্রার্থী করার প্রতিবাদে গঠিত হয়েছিল প্রতিরোধ কমিটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন রফিক ভাই। অনেক জাতীয় পত্রিকায় সে সময় সেই প্রতিবাদের খবর ছাপা হয়েছিল।

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬—সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে ফেনীর সাংবাদিকদের রাজপথের কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। ইকবাল সোবহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে কুশপুত্তলিকা দাহ, মানববন্ধন, অবাঞ্ছিত ঘোষণা—সবই হয় তাঁর নেতৃত্বে। এর প্রতিশোধ এসেছিল ভয়াবহভাবে—২ মে রাতে ফেনী প্রেস ক্লাবের ভেতরে রফিক ভাইয়ের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়। আমি নিজেই সহকর্মীদের সহায়তায় তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। আহত হন জহিরুল হক মিলু, শাহ আলম ভূঁইয়া, জাফর সেলিম, মফিজুর রহমানসহ আরও অনেকে।

আর বিচার? হয়নি। উল্টো রফিক ভাইসহ সাতজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এভাবেই সত্য বলার খেসারত দিতে হয় এই রাষ্ট্রে।

৩ জুলাই ২০২৪, ফেনীর রাজপথে গড়ে ওঠে সাহসী সাংবাদিকদের মানববন্ধন। এই কর্মসূচিকে সফল করতে, সংগঠিত করতে এবং সামনে দাঁড় করাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন রফিকুল ইসলাম।

এই মানববন্ধনের পেছনে ছিলেন সংগঠক সাংবাদিক সাঈদ খান এবং শাহ আলম ভূঁইয়া—যাদের নিঃশব্দ কিন্তু সুসংগঠিত পরিকল্পনায় দাঁড়িয়েছিল এই দৃশ্যমান প্রতিবাদ।

নেতৃত্ব দিয়েছেন:
জহিরুল হক মিলু (৭১ টিভি), শেখ ফরিদ আক্তার (দেশ টিভি), সিদ্দিক আল মামুন (সভাপতি, ফেনী সাংবাদিক ইউনিয়ন), ইয়াসিন সমুন, আমি মেহরাব হোসেন মেহেদী, জসিম ফরাজী, এম এ আকাশ, প্রত্যয়ের শুভ, কাজী মিজানুর রহমান, জাবেদ হোসেন মামুন, আবদুর রহিম, আবু ইউসুফ মিন্টু, নুরুল আফসার, মিরাজ মামুন, রাসেল ও আরও অনেকে।

আমরা যারা সেদিন পাশে ছিলাম, জানি— সেই রাস্তায় দাঁড়ানো মানে ছিল শাসকের ভয়কে অতিক্রম করা। তখন মিলু ভাইয়ের বজ্রকণ্ঠে হুঁশিয়ারি, ফরিদ আক্তার ভাইয়ের জ্বালাময়ী উচ্চারণ, সিদ্দিক আল মামুন ভাইয়ের দৃঢ় বক্তব্য—সব ছিল জনতার পক্ষ নেওয়ার এক স্পষ্ট ঘোষণা।

৩ জুলাই ২০২৪—এই দিনটি শুধু একটি কর্মসূচি ছিল না, ছিল ফেনীর সাংবাদিকতার এক জ্বলন্ত অধ্যায়, যা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল লিপিবদ্ধ থাকবে।

৪ জুলাই, মহিপালে ছাত্র-জনতার লাইভ কাভার করতে গিয়ে ক্যামেরার সামনে হামলার শিকার হন রফিকুল ইসলাম। তাঁকে উদ্ধার করেন ফজলুল করিম, আশরাফ উদ্দীন, রমিজুল হক, সাইফুল ইসলাম ও ফটো সাংবাদিক মিরাজ মামুন।

৫ জুলাই, চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও তিনি রাজপথে ফিরে আসেন—মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই।

তিনি শুধু সাংবাদিক ছিলেন না—তিনি ছিলেন ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাহসী সংগঠক।
সাপ্তাহিক উন্মোচন-এর সম্পাদক হিসেবে জয়নাল হাজারীর সন্ত্রাস ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন, লড়েছেন।

১৯৯৩ সালে দিনে-দুপুরে রাস্তায় তুলে নিয়ে তাঁকে ফেনী কলেজ হোস্টেলের সামনে গাছে ঝুলিয়ে মারধর করা হয়েছিল। এটি ছিল ফেনীর ইতিহাসে সাংবাদিক নির্যাতনের এক কালো অধ্যায়—আর রফিকুল ইসলাম ছিলেন তার প্রথম প্রকাশ্য শিকার।

তিনি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিএ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন (১৯৯৬-২০০১)। সাংবাদিক টিপু সুলতান ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। টিপু ভাই ঢাকায় চলে গেলেও, রফিক ভাই আবার ফিরে এসেছেন ফেনীর মাটিতে—মানুষের পাশে দাঁড়াতে।

আজও তিনি থামেননি। আমরাও থামবো না। তিনি এখনো লিখছেন—আমাদের হয়ে, সাহসের ভাষায়। আমরা তা ছড়িয়ে দিই—কারণ তাতে আমাদের কণ্ঠও মিশে আছে।

একজন সাংবাদিক শুধু সংবাদ দেন না—তিনি সময়কে সাক্ষ্য দিয়ে যান। রফিকুল ইসলাম সেই সাক্ষ্য। সেই ইতিহাস।

আমরা তাঁর সুস্থতা কামনা করি। আমরা তাঁর সাহসকে সম্মান করি। কারণ যখন গণতন্ত্র বিপন্ন—তখন রফিকুল ইসলামদের প্রয়োজন আরও বেশি।

–মেহরাব হোসেন মেহেদী
সম্পাদক, জিএস নিউজ ২৪

আপনার মতামত লিখুন :