আমিরাবাদ আলিম মাদ্রাসায় এতিমদের টাকা অধ্যক্ষের পেটে!

ফেনী প্রতিনিধি ঃ>>>>
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমিরাবাদ আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নুরুজ্জামান কর্তৃক এতিমখানার নামে ডোনারদের থেকে টাকা নিয়ে, ওই অর্থ আত্মসাতের ঘটনা জানাজানি হলে স্থানীয় অভিভাবক ও অন্যান্য লোকজনের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মাদরাসার অডিট তদন্তের রিপোর্টে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এতিমদের নামে অর্থ সংগ্রহ করে আত্মসাতের সত্যতা মেলে। তদন্ত কমিটির কাছে হিসাব না দিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক আশ্রয়ে পার পেতে নানা অপকৌশল চালাচ্ছেন অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান। এতিম ছাড়াই আমিরাবাদ আলিম মাদরাসায় আনোয়ারা বেগম এতিমখানার প্রায় ১৬লাখ টাকা উক্ত মাদরাসার অধ্যক্ষ নুরুজ্জামানের পকেটে। উন্নয়নসহ বিভিন্ন আরো প্রায় সাত লাখ টাকা নিজেই আত্মসাত করেছেন বিভিন্ন কৌশলে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আমিরাবাদ আনোয়ারা বেগম এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ও তাঁর ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁদের মায়ের নামে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান পদাধিকার বলে এককভাবে আধিপাত্যে চালিয়ে এতিমখানাটি পরিচালনা করে আসছেন। এক্ষেত্রে মাদরাসায় এতিম শিক্ষার্থী না থাকলেও নামে-বেনামে অর্থ লোপাট করেছেন তিনি।
শুরু থেকেই এলাকার দানবীরদের অর্থায়নে এতিমখানাটি পরিচালিত হয়ে আসছিল। এ কারণে মাদরাসার কোন কমিটিই এতিমখানার আয়-ব্যয়ের কোন হিসাব দেখেনি কখনো। যার ফলে অধ্যক্ষ নুরুজ্জামানের কোন জবাবদিহিতাও ছিল না। ইতোমধ্যে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এতিমদের অর্থ আত্মসাতসহ নানা অভিযোগ উঠলে একটি অডিট কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত অডিট কমিটির সদস্যরা শুধুমাত্র ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের সংক্ষিপ্ত হিসাব নিরীক্ষা করতে গিয়ে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। গভর্ণিংবডির নির্দেশনা অনুযায়ী নিরীক্ষা কমিটি এতিমখানার কোন রেজুলেশন বই, ক্যাশ বই, চাঁদা আদায়ের রশিদ, বছর ওয়ারী এতিমদের রেজিষ্ট্রার, ডোনারদের অনুদানের এস্টেটমেন্টসহ কোন কিছুই সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র এতিমখানা/দরিদ্র তহবিলের ক্যাশ বই, আয়-ব্যয়ের রশিদ যাচাই, হোসাফ গ্রুপের প্রদত্ত হিসাব যাচাই, এতিমদের রেজিষ্টার ইত্যাদির উপরে হিসাব নিরীক্ষন করে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের হিসাবে দেখা গেছে ২০১০ সালের সমাপ্তি জের ছিল ৫৩ লাখ ৭শত ৩৯ টাকা, ২০১১ সালে ডোনারদের অনুদান বাবদ ১ লাখ ২১ হাজার টাকা, এলাকার মানুষের দান ৫৮ হাজার ২শত টাকা, কোরবানীর চামড়া বাবদ আয় ৭২ হাজার ৭শত ৭২ টাকা, যাকাত বাবদ আয় ৮৬ হাজার ৮শত ৭০ টাকা, ছাত্র-শিক্ষা বোর্ডিং ভাড়া বাবদ আয় ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫শত ৪৬ টাকা, বিদ্যুত খাতে ৬ হাজার টাকা। সর্বমোট উক্ত বছরে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৩শত ৮৮ টাকা আয় দেখানো হয়েছে।
ব্যয় বাবদ এতিম ছাত্রদের পেছনে হোস্টেল ব্যায়, বিদ্যুত বিল, শিক্ষক-কর্মচারী বেতন, কিতাব ক্রয় বাবদ উক্ত বছরে সর্বমোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৭শত ১৩ টাকা। উক্ত বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার ৬শত ৭৫ টাকা।
এরপর ২০১২ সালের আয় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ১শত ৬৭ টাকা ও ব্যয় দেখানো হয়েছিল ২ লাখ ৩৯ হাজার ২শত ৪৬ টাকা। উক্ত বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ২ লাখ ২৮ হাজার ৯শত ২১ টাকা।
২০১৩ সালে আয় ছিল ৩ লাখ ২৭ হাজার ৮শত ৫৭ টাকা আর ব্যয় দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ৬৪ হাজার ৪শত ৮১ টাকা। উক্ত বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৩শত ৭৬ টাকা।
২০১৪ সালে আয় দেখানো হয়েছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৪ টাকা। আর ব্যয় দেখানো হলো ১ লাখ ১১ হাজার ৭শত ৪ টাকা। সে বছর উদ্বৃত্ত ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ৩শত ৪০ টাকা।
২০১৫ সালে উক্ত এতিমখানার আয় দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৯০ টাকা আর ব্যয় দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ৬শত ৪১ টাকা। আর ঐ বছর এতিমখানা ফান্ডে উদ্বৃত্ত ছিল ৪২ হাজার ৬শত ৪৯ টাকা।
উল্লেখিত পাঁচ বছরের হিসাবের টাকা অধ্যক্ষ নুরুজামান আয় ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮৫ টাকা আর ব্যয় দেখিয়েছেন ৯ লাখ ২৮ হাজার ৮শত ৮৭ টাকা। অর্থাৎ আয়-ব্যয়ে হিসাব দেয়ার পরও এতিমখানা ফান্ডে ৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯শত ৯৮ টাকা উদ্বৃত্ত থাকার কথা (অধ্যক্ষের দেয়া হিসাবমতে।)
এছাড়া ডোনারদের অনুদানের এতিমখানা ফান্ডের ৩টি রশিদের অনুকূলে আদায় করা ৪৫ হাজার, ওই টাকা আয়ের খাতে না দেখিয়ে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে গোপন করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে উক্ত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকার খরচের যে হিসাব দেয়া হয়েছে তার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক জানান, গত কয়েক বছরে উল্লেখিত এতিমখানায় কোন এতিম শিক্ষার্থী ছিল না। আবাসিক যে কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিল তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে এতিম দেখিয়ে অধ্যক্ষ ভুয়া বিল-ভাউচারের মধ্য দিয়ে অর্থ আত্মসাত করেছেন।
অডিট কমিটি হিসাব নিরীক্ষাকল্পে গভর্ণিং বডির কাছে যে মন্তব্য ও সুপারিশের কারণ তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো : (১) এতিমখানা পরিচালনার জন্য কোনো কমিটি নেই, এতিমখানার কোনো রেজুলেশন বই বা কোনো প্রয়োজনীয় বিষয়ে লিখিত কোন সিদ্ধান্তে কাগজপত্র বা রেজিষ্টার পাওয়া যায়নি। (২) এতিমখানার নামে ছাপানো রশিদ বই এর রেজিষ্টার ও বিতরণ রেজিষ্টার নেই। (৩) এতিমখানার ব্যবহৃত ও অব্যবহৃত রশিদ বই এর কোন হিসাব নেই। (৪) এতিমদের কোন রেজিষ্টার বা তালিকা নেই। কত সালে কত জন এতিম শিক্ষার্থী ছিল তারও কোনো সঠিক হিসাব দিতে পারে নাই। তবে হাজিরা খাতা আছে। (৫) গভর্ণিং বডি ও অডিট কমিটি সদস্য কামাল উদ্দিন, মাস্টার আইয়ুব ও সাজ্জাদ হোসেন মাদরাসা চলাকালীন সময় সরেজমিনে তদন্ত করে ২০১৫ সালে আলিম ক্লাশের ছাত্র-১, ফিরোজ ১০ মাস ফ্রি খাওয়া ও সালাহ উদ্দিন ১ মাস ফ্রি খাওয়ার হিসাব পেয়েছেন। ২০১৪ সালে ফিরোজ ১০ মাস, কাউছার ১০ মাস, শুভ ৪ মাস, রায়হান ৫ মাস, সালাহ উদ্দিন ১ মাস, মোট ৩০ মাস। মোট ৫জন মাস হিসেবে ৩০ মাস ফ্রি খেয়েছে। এছাড়া তদন্তে এতিম বা ফ্রি খাওয়ার কোন ছাত্রের হিসাব বা প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। (৬) ২০১৩, ২০১২ ও ২০১১ সালে কোন এতিম ও দরিদ্র ছাত্র ফ্রি হোস্টেলে খেয়েছে এমন কোন তালিকা বা রেজিস্টার প্রমাণাদি অডিট কমিটিকে অধ্যক্ষ দেখাতে পারে নাই। (৭) ২০১১-২০১২, ২০১৩-২০১৪ সাল, এই ৪ বছরের কোন ব্যয় ভাউচার পাওয়া যায় নাই।
শুধুমাত্র পাঁচ বছরের খতিয়ানে দেখা যায় অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান এতিমখানার প্রায় ১৬ লাখ টাকা আত্মসাত করে এখনও মাদরাসায় অধ্যক্ষের চেয়ারে বহাল রয়েছেন। এতে করে স্থানীয় এলাকাবাসী, মাদরাসার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান অনিয়ম, দুর্ণীতির মাধ্যমে এতিমদের অর্থ আত্মসাত করে কিভাবে স্বপদে বহাল রয়েছেন তা কেউ মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা বিষয়টি তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট যথাযথ হস্তপেক কামনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নুরুজ্জামান অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ওই মাদরাসায় বর্তমানে কোনো এতিমখানা নেই। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এটি তাঁর বিরুদ্ধে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে।