নতুন মন্ত্রিসভার চ্যালেঞ্জপূর্ণ উদ্যোগে যা থাকছে

স্টাফ রিপোর্টার:>>>
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ।
সোমবার বিকালে বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান। বিপুল জয়ের পর গঠিত নতুন মন্ত্রিসভায় তারুণ্যের শক্তি, মেধাকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলনই ঘটানো হয়েছে। নতুন মন্ত্রিসভা নেবে চ্যালেঞ্জপূর্ণ উদ্যোগ।
বিশিষ্টজনরা বলেছেন, এই মন্ত্রিপরিষদের ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। আগামীর বাংলাদেশ গড়তে যে বিপুল বিনিয়োগ ও ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান দরকার তারা তা করতে পারবেন। একই সঙ্গে দুনীর্তি হ্রাস, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায়ও তারা চ্যালেঞ্জপূর্ণ উদ্যোগ নেবেন।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান জিএস নিউজকে বলেছেন, নতুন মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে আমরা আশাবাদী। এখানে প্রবীণ এবং তরুণদের ঠাঁই হয়েছে। তারুণ্যের শক্তি এবং প্রবীণের অভিজ্ঞতা দুইয়ে মিলে যে মন্ত্রিপরিষদ গঠন হল, আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তারা সফল হবেন সেটি বিশ্বাস করা যেতেই পারে।
তিনি বলেন, কিছুটা সময় শুরুতে তাদের দিতে হবে শিখে ওঠার জন্য। একেবারে অস্থির হলে চলবে না। প্রয়োজনে দেশে পেশাজীবী যেসব সংগঠন ও ব্যক্তি রয়েছে, তাদের সঙ্গে শুরুতেই মতবিনিময় করে নেয়া যেতে পারে। জাপানে এটা স্বীকৃত পদ্ধতি। যদি পেশাজীবী, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও নাগরিক সমাজ এবং সরকারের বর্তমান ও সাবেক আমলাদের সঙ্গে বসে উপদেশ নেয়া হয়, তাহলে কাজটি সহজ ও গতিশীল হবে।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ মনে করেন, সর্বত্রই এখন সমাজ এবং চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনের স্লোগান। এ মন্ত্রিসভায় তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করে তার প্রতিফলনই দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেটি চমকের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বাস্তবতায় এটিই সময়ের ডাক।
তাছাড়া আ’লীগ প্রবীণ রাজনৈতিক দল। এ দলটির প্রতি জনমানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশাও। তাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছেন।
তিনি বলেন, দেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে প্রধানমন্ত্রীরও একটা ভিশন রয়েছে। তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের উদ্যমী, মেধাবী, পরিশ্রমী, আত্মপ্রত্যয়ী ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ টিম দরকার- সদ্য গঠিত মন্ত্রিসভার সেটিই হয়েছে। নবীন-প্রবীণের এই সমন্বিত ধারা বজায় রেখে সব অঞ্চল ও শ্রেণী-কাঠামো ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রতি সমান দৃষ্টি রেখে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখাই হবে তাদের মুখ্য চ্যালেঞ্জ।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জিএস নিউজকে বলেন, দুনীর্তি হ্রাস, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করার যে প্রচেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে- গঠিত মন্ত্রিসভা তা পূরণ করতে পারবে বলেই মনে হচ্ছে। মন্ত্রিসভায় অনেকে নতুন হলেও রাজনীতিতে কিন্তু তারা অভিজ্ঞ এবং মেধাবীও। নতুন উদ্যোগে ‘ম্যানেজমেন্ট অব কম্বিনেশন অব নিউ স্কিল’ বলে একটা কথা আছে। এখানে সেই নবীন-প্রবীণের নতুন মাত্রা, নতুন উদ্যম ও কর্মস্পৃহা দেখতে পাচ্ছি, যা সবারই প্রত্যাশিত ছিল।
তিনি বলেন, আগামী দিনে ভিশন-২০২১ অর্জন, উন্নয়নশীল দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নত দেশের মতো পরিবর্তিত বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখছি, সেখানে প্রয়োজন হবে ব্যাপক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির। এ দুটি ছাড়া অর্থনীতি বিকশিত হবে না। আমরা মনে করছি, এই নতুন মন্ত্রিসভা সেই প্রত্যাশা পূরণ করবে। সবকিছুতেই মনে হয় এবার একটা পরিবর্তন আসবে।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সবকিছুই নির্ভর করবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। মন্ত্রিসভা নতুন-পুরনোর সমন্বয়ে হয়েছে সেটা খারাপ কিছু নয়। আশা করছি এই মন্ত্রিসভা দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে। তবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে তাদের জন্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। সংসদসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য। তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার শক্তি নেই।
তিনি বলেন, জবাবদিহিতার ক্ষেত্র সংকুচিত। আর একটি চ্যালেঞ্জ হল এই নির্বাচন ও ফলাফলের নেপথ্যে যারা কাজ করেছেন তাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছে। যারা স্থান পাননি তাদের চাহিদা ও জনগণের চাহিদা ও প্রত্যাশার মধ্যে সমন্বয় থাকলে কোনো কথা নেই। কিন্তু যদি এই চাহিদা ও প্রত্যাশা সাংঘর্ষিক হয় তাহলে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হতে পারে। সুশাসন ব্যাহত হতে পারে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল প্রধানমন্ত্রী বলেছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা। কিন্তু এ ধরনের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হল দেশের সব ধরনের নাগরিকের বাকস্বাধীনতা থাকা। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে দেখা গেছে বাকস্বাধীনতা খর্ব করার মতো আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যে কারণে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও স্বাধীনতার মৌলিক পরিবেশ সাংঘর্ষিক রূপ নেবে। এ কারণে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে আমি মনে করছি।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জিএস নিউজকে বলেন, চমকের মন্ত্রিসভার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহারের যথাযথ বাস্তবায়ন। দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্সে নামিয়ে আনা। কার্যকর সুশাসন নিশ্চিত ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় উন্নতির পাশাপাশি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও অন্তর্ভুক্তিকরণের রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস এই মন্ত্রিসভা এসব বিষয়ে আন্তরিক ও মনোযোগী হবে। মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যই হয়তো অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নন। কিন্তু তাদের তারুণ্য আছে, মেধা আছে। তরুণদের কাজ করার সামর্থ্যও বেশি। আমরা আশাবাদী হতেই পারি।
তবে শঙ্কার কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারা কঠোর না হলে এবং ইশতেহার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে তা হবে সরকার এবং দেশের জনগণ উভয়ের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক। যা সবার জন্য অমঙ্গলই ডেকে আনবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার জিএস নিউজকে বলেন, সামনে সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামগ্রিকভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা। আর্থিক খাতে নানা অনিয়ম বহুল আলোচিত। সরকারের হাতে অনেকগুলো বড় প্রকল্প চলমান আছে।
সেগুলো শেষ করতে হবে। দুর্নীতিও সরকারের জন্য বড় সমস্যা। এটা দূর করতে হবে। দেশে একদিকে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, অন্যদিকে আয় বৈষম্য বাড়ছে। এতে দরিদ্র মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে পারে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে অনেক সাবধান ও সাহসের সঙ্গে এগোতে হবে।
প্রশাসনবিষয়ক এই কলামিস্ট বলেন, নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের অধিকাংশই নতুন। এটা এক অর্থে ইতিবাচক। কেননা পুরনোদের তো নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। নয়তো নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে না।
তবে আগের মন্ত্রিসভার অভিজ্ঞ ও জাতীয়ভাবে পরিচিত নেতাদের কয়েকজনকে নতুন মন্ত্রিসভায় রাখা যেত। সরকার পরিচালনার জন্য তাদের মতামত ও দক্ষতাকে কাজে লাগানো যেত। সরকারের সামনে সুশাসন নিশ্চিত করা ও মানুষের আস্থা অর্জন করা বড় চ্যালেঞ্জ।