কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোক নির্বাচন কমিশন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, জিটিভিঃ>>>>
কাল ভোট। সংসদ নির্বাচন। পাঁচ বছর পর একটি সংসদ নির্বাচন হতে চলেছে। অনেকে বলেন দশ বছর পর আবার সত্যিকারের জাতীয় নির্বাচনে যাচ্ছে বাংলাদেশ, কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে বড় দল বিএনপিসহ তার মিত্ররা অংশ নেয়নি এবং সেই নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে তারা সফল হয়নি। তাই আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের একেবারে দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।
কী বলবে ভোটের ফল? কোন এলাকায় কোন নেতার বা দলের কতটা দাপট? আইন প্রণেতা নির্বাচনের জন্য ভোট হয়। কিন্তু আমাদের এখানে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠে দলীয় ও ব্যক্তি বিশেষের দাপট প্রতিষ্ঠা করা। তাই ভোটের ফলাফলে বিজয়ী দলের জন্যই বরাদ্দ থাকে সব কিছু বা বিজয়ী দলই সব দখলে পায়। পরাজিতের জন্য কিছু থাকে না।
ভোট মানেই খতিয়ান, কাজের খতিয়ান। কে কত কাজ করেছে যার যার আসনে। রাস্তা, সেতু, কালভার্ট, বিদ্যুৎ, পানি, সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবস্থা করাই এমপিদের কাজ। ভোটারের ভাবনার মধ্যে আছে কাজ আরও ভাল হয়েছে, কি মন্দ হয়েছে। ভোটের প্রচারে সেসবই ভাসতে থাকে আর মিডিয়ার ভোট-সংবাদেও তা প্রচার হতে থাকে।
কিন্তু কোথাও তেমন আলোচনা নেই যে, কীসে কত টাকা খরচ হল। অথচ তার উপরেই তো ভোট দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল। গ্রামের জন্য বরাদ্দ টাকা গ্রামের মানুষের কতটা কাজে লাগল, আদৌ তাদের জন্য খরচ হল কি না, সেই প্রশ্নইতো ভোটের প্রশ্ন। তার উত্তর না জেনেই ভোটের লাইনে যদি দাঁড়াতে হয়, তাকে কি গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা চলে? কিন্তু আমরা বলেই চলেছি।
তবে হয়েছে বই কি? গত দশ বছরের শেখ হাসিনার দুই মেয়াদে বড় কাজ হয়েছে। অবকাঠামোখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বাংলাদেশ প্রান্তিক পর্যায়েও আলোকিত এবং যে কারণে আওয়ামী লীগ এবার বলছে আবার ক্ষমতায় এলে তাদের লক্ষ্য গ্রামকে শহরে পরিণত করা। বাংলাদেশের মানুষের আয় ও ব্যয় সক্ষমতা ও সামাজিক নানা ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় ঈর্ষণীয়। এসবই মানুষের অর্জন সরকারের সহযোগিতায়।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত গড়ে দিয়েও মানুষের কাছে ভোট প্রার্থী হতে গিয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে, অনেক বৈরি পরিস্তিতির মুখে আওয়ামী লীগ। কারণ ক্ষমতায় থাকলে বিরুদ্ধ মন্তব্য বেশি শুনতে হবেই। এবং উন্নয়ন হলেও সুশাসনের অনেক স্তরের ঘাটতি ভাবমূর্তির ঘাটতি তৈরি করেছে অনেকখানি।
অন্যদিকে সন্ত্রাস সহিংসতা লালন, ২০০১-এর নির্বাচনে জেতার পর দেশব্যাপী সংখ্যালঘু নির্যাতন, গ্রেনেড হামলা করে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা, জঙ্গিবাদে মদদদান, লাগাতার পেট্রল বোমা মেরে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারাসহ যুদ্ধাপরাধীদের সাথে রেখে রাজনীতি করার ভাবমূর্তি নিয়ে ভোটের মাঠে আরেক বড় দল বিএনপি। এর সামনের সারিতে অবশ্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে কিছু নাগরিক রাজনীতিবিদ।
এই নাগরিক রাজনীতিকরা থাকায় যতটা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি আসতে পারতো ঐক্য ফ্রন্টের কপালে, রাজনীতির বাস্তবতায় তা আসেনি। দেখা যাচ্ছে ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর নিয়েও শক্ত অবস্থানে ক্ষমতাসীন দল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৪৮টি আসনে জয়ী হতে পারে বলে অনুমান করছে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরডিসি)। আর ঐক্যফ্রন্ট পাবে ৪৯টি আসন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী বা অন্যান্যরা পাবে তিনটি আসন।
গত বুধবার দুপুর আরডিসি এক ছায়া ভোটের ফলাফল প্রকাশ করে। যা রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ফলাফল তুলে ধরেন আরডিসির অর্থনীতিবিদ ফরেস্ট ই কুকসন। তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একজন পরামর্শক।
ফলাফলে দেখা যায়, দেশের ভোটারদের ৬০ শতাংশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। আর বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টকে দিয়েছে ২২ শতাংশ ভোটার। এই ভোটে ১০ শতাংশ মানুষ কাকে ভোট দেবেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি।
আরডিসি বলছে, ৯ থেকে ১৬ ডিসেম্বর দেশের ৫১টি সংসদীয় আসনে সোয়া দুই হাজার ভোটারের ওপর জরিপ চালিয়ে তারা এ পূর্বাভাস পেয়েছে। ভোট জরিপে অংশ নেয় ২ হাজার ২৪৯ জন ভোটার।
ফলাফলে আওয়ামী লীগকে ভালো বলেছে, ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ। আর খারাপ বলেছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। অপরদিকে বিএনপিকে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ ভালো বলেছে। আর খারাপ বলেছে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ।
প্রায় আড়াই কোটি নতুন ভোটারসহ ১০ কোটি মানুষ ভোট দিবে কাল। নতুনদের সামনে বড় রাজনীতির দৃষ্টান্ত নেই, আছে বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ার স্বপ্ন যা শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। একদিকে তারা যেমন শাসক গোষ্ঠির অতি শক্তি প্রয়োগকে সমালোচনা করে, অন্যদিকে তার কাছে বাস্তবতা হলো এই সরকারই তাদের বিশ্বের সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তারা বল প্রয়োগের রাজনীতি চায় না, তারা যুদ্ধাপরাধী দলের রাজনীতিও চায় না।
এসব সমীকরণ নিয়েই কাল নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি শেষ। দেশের সব নির্বাচনী এলাকায় ব্যালট পেপার পাঠানো হয়েছে। যেসব নির্বাচনী এলাকায় ভোট নেওয়া হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে সেসব জায়গায়ও এ-সংক্রান্ত প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতির পাশাপাশি শেষ মুহূর্তে প্রচার-প্রচারণায় ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন প্রার্থীরা।
অন্যান্যবারের নির্বাচনে দেশের সংখ্যালঘুদের উপর যে পরিমাণ আঘাত হয়, তা এবার হয়নি দলীয় সরকারের প্রশাসনের শক্ত অবস্থানের কারণে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে দেশের কোথাও কোথাও সংঘাতের ঘটনা জনমনে আশঙ্কা তৈরি করছে। বিশেষ করে প্রার্থীদের উপর সরাসরি আঘাত আগে কখনও এমনভাবে দেখা যায়নি।
প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কর্মী-সমর্থকদের হামলা-পাল্টা হামলার অভিযোগ নির্বাচনী পরিবেশ কোন কোন স্থানে দূষিত হয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে শান্তিতে ভোট হোক। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুব কঠিন নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পক্ষে। উত্তীর্ণ না হলে সন্ত্রাসী ও সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের দাপট বাড়বে। আর তা হলে ভবিষ্যতের পথটা কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠবে দেশের জন্য।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।