ধর্ষণ কেবল নারী নির্যাতন নয়, বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:>>>>>>>
বনানীতে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার শাফাত আহমেদকে ৬ দিনের এবং সাদমান সাকিফকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে এই দুজনকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়।বিচারের একটি প্রক্রিয়া শুরু হলো মাত্র। অভিযুক্তদের বেশ কয়েকজন এখনো আটক হয়নি। যে কাজ পুলিশের, সে কাজে পুলিশের বিলম্ব দেখে মূলধারার ও স্যোশাল মিডিয়া জনমত চাপ তৈরি করে তদন্ত ও বিচার করার জন্য। আজকের মানুষ অনেক সচেতন। সে আদৌ পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছে না। সামাজিক মিডিয়ায় খবর ছড়াচ্ছে দ্রুত, প্রতিযোগিতার দাপটে মূলধারার মিডিয়াও বসে নেই।
বাংলাদেশে এখন যত ধরনের অপরাধ হয় তার মধ্যে সর্বাধিক বেড়েছে ধর্ষণ। খুন, ডাকাতি, অপহরণের চেয়ে কোন অংশে কম নয় ধর্ষণের ঘটনা। এটা সত্য যে, আগের তুলনায় এখন বেশি সংখ্যক মেয়ে ধর্ষণের পর থানায় সে বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করে। তার অর্থ হলো, আগে যা গোপন থাকতো, তার কিছু কিছু প্রকাশ হতে শুরু করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের পরিচিত কোনও ব্যক্তিই তাদের উপর এই নিগ্রহ করে, যেমনটি বনানী ধর্ষণকাণ্ডে দেখেছি আমরা। বন্ধুত্বে বিশ্বাস করাই যেন ছিল অপরাধ। এসব তাহলে কিসের ইঙ্গিত? প্রশাসনে এবং রাজনীতিতে বড় নারীদের উপস্থিতি আছে, অর্থনীতিও উন্মুক্ত বাজারে নারীদের শ্রম এবং উৎপাদনকৌশলের মর্যাদা দিচ্ছে, তবুও কেন এই অবস্থা আজ? তবে কি সমাজ ব্যবস্থা নারীদের ভয় পেতে শুরু করেছে, যেমন নারীদের আজীবন ঘৃণা ও ভয় করে ধর্মান্ধ শ্রেণি? নারীদের পীড়ন করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবার চেষ্টা চলছে।
পুরুষ ধর্ষণ করে কেবলই যৌন ইচ্ছা পরিপূরণের উদ্দেশ্যে? আসলে তা নয়। তার মনস্তত্বে আরো অন্য উদ্দেশ্য কাজ করে। সে চায় নারীকে তার যথার্থ স্থানটি চিনিয়ে দিতে। মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক শক্তি আর এসব পশ্চিমা পোশাকী ধর্ষক একই মানসিকতার। তারা চায় নারী কেবলই পুরুষের যৌন আকাঙ্খা মেটানোর পুতুল হয়ে থাকবে, মানুষ হিসেবে নয়। এ কারণেই সাধারণ নারীতো বটেই, উপজেলায় বা ইউনিয়নে, কিংবা সংসদীয় এলকায় যে নারীরা কাজ করছে, সমাজ পরিবর্তনে সক্রিয় তাদেরও ছাড় দেয়া হচ্ছেনা। ধর্ষণ মূলত পুরুষের যৌনতার প্রকাশ নয়, ক্ষমতার প্রকাশ।
পুরুষতন্ত্র, শ্রেণি ব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র, আধিপত্য বজায় রাখবার একটি উপায় হলো নারী ধর্ষণ। একবিংশ শতকের বাংলাদেশে এসেও পুলিশ ধর্ষকদের গ্রেপ্তারে দ্বিধা দেখিযেছে শুধুমাত্র এদের আর্থিক ক্ষমতার কারণে। শেষ পর্যন্ত সামাজিক চাপে আইন প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। ধর্ষিতা বা নির্যাতিতা সব দিকেই ঝুঁকিতে থাকে। এমনকি নিজের পরিবারও নারীদের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ। নিজ বাড়িতেও গৃহবধূ বা কিশোরী কন্যারা নিরাপদ নয়।
ধর্ষণ কেবল নারী নির্যাতন নয়, তা বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের একটি প্রকাশ। তাই ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে গুরুত্ব দেয়া এবং তার প্রতিকার করা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি। দুঃখজনক এই যে, রাষ্ট্র এ বিষয়ে তার কর্তব্য পালনে পিছিয়ে থাকে, যেমন পিছিয়ে আছে কুমিল্লা সেনানীবাসে তনু হত্যার ঘটনায়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, অথচ রাষ্ট্র কিছুদূর গিয়ে তদন্ত সম্পন্ন না করেই নিরব হয়ে গেছে। বনানী ধর্ষণকাণ্ডে অভিযোগকারী দুই তরুণীর মামলা নিতে পুলিশ বিলম্ব করেছে ৪৮ ঘণ্টা। মামলা নেয়ার পরও অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়ভাবে ধীর গতির। পুলিশ অভিযোগের তদন্ত করে অভিযোগ গঠন করে কম, আদালতেও নিষ্পত্তি হয় খুব কম ঘটনাই। এই দুটিই অত্যন্ত উদ্বেগজনক দিক। এমনিতেই প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য উপস্থিত করা কঠিন বলে, প্রমাণের অভাবে বহু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত মুক্তি পেয়ে যায়। তার উপর যদি তদন্ত এবং বিচারের স্তরেই অভিযোগ পৌঁছুতে না পারে, তাহলে ধর্ষণের ন্যায় গুরুতর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে।
শাস্তির কঠোরতা চায় সমাজ, কিন্তু এর চাইতেও শাস্তির নিশ্চয়তা বেশি প্রয়োজন। সেটাই অপরাধীদের নিরস্ত করে বেশি। অতএব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে সজাগ হতে হবে। প্রয়োজনে ধর্ষণের অপরাধের জন্য আরো দ্রুততর কোন বিচারিক প্রক্রিয়ার কথা ভাবা হোক। ধর্ষণ কেবল মাত্র নারীর সন্মানহানি নয়, তার অধিকার কেড়ে নেয়াও। ‘মেয়েটি যে-ই হোক, যেখানেই যাক, যেমন পোশাকই পরুক, তার শরীরের উপর অধিকার তারই,’- এই দর্শনই হোক বাংলাদেশের দর্শন।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।