কোটাধারীরা আর কতদিন পেনাল্টিতে গোল দেবে?

GS News 24GS News 24
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ১২:২৬ পিএম, ০১ মার্চ ২০১৮

আমাদের দেশে বিসিএস সরকারী চাকরিতে কোটা অনেকটা এরকম- ৩০ শতাংশ মুক্তযোদ্ধা, ৫ শতাংশ উপজাতি, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা আর ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সব মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তার মানে ৪৪ শতাংশ মেধার জোরে আর  বাকি সবাই সরকারি চাকরিতে ঢুকছে কোটার জোরে। তবে বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে মেধার চেয়ে কোটার জোর এতো বেশি আছে বলে আমার জানা নাই।

অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ১৯৭২ সালের ৫ নভেম্বর এক নির্বাহী আদেশে সরকারি, বেসরকারি, আধা সরকারি, এবং জাতীয়করণ প্রতিষ্ঠানে জেলা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৩০ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১০ ভাগসহ ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের জন্য কোটা প্রবর্তন করা হয়। পরে বিভিন্ন সময় এ কোটা প্রথা সংস্কার ও পরিবর্তন করে বর্তমানে জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয়ের ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি নিয়োগে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু রাখা রয়েছে।

কোটা-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রশাসনে মারাত্মক গোলযোগের সৃষ্টি হয়েছে। যোগ্য প্রার্থীর অভাবে অনেক পদ বহুদিন যাবৎ খালি পড়ে আছে। এভাবে খালি পড়ে থাকা অথবা অযোগ্যদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণের ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাষ্ট্র আপনা-আপনিই অকার্যকর হয়ে পড়বে। যোগ্য মেধাবীরা হতাশায় উগ্রবাদী হয়ে উঠতে পারে। সে উগ্রবাদ হতে পারে ধর্মীয় মৌলবাদী অথবা লেনিন-স্ট্যালিন-মাওবাদী। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে দুটোর সম্ভাবনাই প্রবল। অবিচার ও বৈষম্য মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে।

বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। প্রতিবছর অন্তত ১০ লাখ মেধাবী ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজ থেকে বের হচ্ছে। তারা বিরাট মানবসম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারছে না রাষ্ট্র। আমাদের দেশের চাকরির ক্ষেত্রটি এভাবে তুলনা করা যায় যে, এই ক্ষেত্রটি এমন এক ফুটবল মাঠের মতো পরিণত হয়েছে। যেখানে কোটাধারীরা পেনাল্টিতে গোল দিচ্ছে আর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে গোলে কিক নেয়ার আগেই কোটাধারীদের আক্রমণে পরাস্থ হচ্ছে।

কোটা পদ্ধতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যাদের জন্য কোটা দরকার তারা না পেয়ে পাচ্ছে অন্যরা। এ কোটা পদ্ধতি তাদের জন্য দরকার যারা চলতে-ফিরতে পারে না। যাদেরকে বলা হয় প্রতিবন্ধী। কিন্তু এ সকল মেধাবী মেধার সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছে না। আর এ কোটার মাধ্যমে যারা সরকারের বিভিন্ন মহলে নিয়োগ পাচ্ছে তাদের দ্বারা অন্যায় ছাড়া ন্যায় কোন কিছু পাওয়া যাবে না। মুক্তিযোদ্ধা তাদের জন্য অল্প কিছু সুযোগ রাখা অবশ্যই দরকার। তবে ৩০% কমিয়ে আনতে হবে। কারণ বাংলাদেশে যে হিসেবে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হিসেবে চাকরি পাওয়া খুবই দুরূহ। আর তাই কোটা পদ্ধতির হার কমিয়ে সকল শিক্ষার্থীকে চাকরি করার সুযোগ করে দেয়া যে কোন সরকারের আবশ্যিক কর্তব্য

পিএসসির তথ্যানুযায়ি, প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেন তারা। কিন্তু চলতি বছরের হিসেবে এবারে ৩৮ তম বিসিএসে অংশ নেন সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থী। কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি নাও পেতে পারেন। কারণ ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে। কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না। আবার কোটা থাকলে কেউ সাত হাজারতম হয়েও চাকরি পেতে পারেন।

আর সবচেয়ে বড় সংকট কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে ওই পদগুলো শুন্য রাখতে হয়। ফলে একদিকে যেমন মেধাবীরা নিয়োগ পায় না অন্যদিকে হাজার হাজার পদ শুন্য থাকে। বিগত কয়েকটি বিসিএসের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যাওয়ায় ২৮ থেকে ৩৫তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে পাঁচ হাজার পদ খালি থেকে গেছে।

যার ফলে মেধাবীরা উত্তীর্ণ হয়েও একদিকে চাকরি পাচ্ছে না, আর অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কৃষি কর্মকর্তাদের মতো কারিগরি ক্যাডারের প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন।

তবে শুধু বিসিএস নয়, গত বছর ৯ হাজার ৬০৯ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ করা হয়। এসব পদের মধ্যে ২ হাজার ৮৮২টি পদ মুক্তিযোদ্ধার কোটাভুক্ত ছিল। কিন্তু এর জন্য প্রার্থী পাওয়া গেছে মাত্র ১০১ জন। কোটার প্রার্থী না পাওয়ায় রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার পদ শুন্য থাকছে। অথচ লাখ লাখ ছেলেমেয়ে একটা চাকুরি পাচ্ছে না। সবাই আমরা কোটা ব্যবস্থার বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। কিন্তু আর কত কাল চলবে এই বৈষম্য?

আমরা সবাই জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য ও অবিচার মেনে না নেওয়া। ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বৈষম্যের অনেকটা ফয়সালা আমরা অর্জন করতে পেরেছিলাম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য এর পরও বেড়েছে দিন দিন। এই বৈষম্যের সবচেয়ে উৎকট প্রকাশ ঘটত উন্নয়ন বাজেট ও সরকারি চাকরিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্যে। বাঙালিদের মেধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে অধিকাংশ নিয়োগ দেওয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ছয় দফার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে এসব তথ্য-উপাত্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ক্ষোভকে সংগঠিত করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে আমরা তাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান লক্ষ করি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তত ছয়টি বিধানে সমতা ও বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আছে।

সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা, ২৮ অনুচ্ছেদে বৈষম্যহীনতা এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে সব নাগরিকের সুযোগের সমতার কথা বলা আছে। অবশ্য ২৮ অনুচ্ছেদে নারী, শিশু ও ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির’ জন্য এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর’ অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে।

তাই কোটা নামের যে কাঁটা নাগরিকের সমঅধিকার কেড়ে নিয়েছে তা আর মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এই কাঁটা সহ্য করার ক্ষমতা আমরা তরুণরা আজ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা এই কাঁটা থেকে মুক্তি চাই। খুব দ্রুতই কোটা সংস্কারের উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে, কীভাবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়।

এ দেশ আমাদের সবার। এখানে কোনো বিভাজন কাম্য নয়। আর দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে মেধাবীদের স্থান পাওয়াটা খুবই জরুরি। কোটার ফাঁদে পড়ে মেধাবীরা যেন চাকরি বঞ্চিত না হয় এবং অমেধাবীরা যেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢুকে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। না হলে সর্বনাশ হবে আমাদের দেশেরই।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক। 

আপনার মতামত লিখুন :