ক্যাশ-ফ্লো সঙ্কট থেকে বেঁচে থাকার কৌশলসমূহ

বিরাজমান করোনাভাইরাস দুর্যোগে প্রায় সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এই সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করতে সরকার থেকে কয়েক রকম প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো তবেই এর পূর্ণ সুবিধা নিতে পারবে, যদি তা’দের ক্যাশ-ফ্লো নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা থাকে।
আমাদের দেশে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কাজে দক্ষ হলেও, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বেশ কাঁচা। কোন কোন সময়ে এ ব্যাপারে তা’রা কিছুটা অমনোযোগীও বটে। যখন কাজ থাকে, ব্যবসায় যখন ভাল চলে, তখন এই ফাণ্ড নিয়ন্ত্রণে অবহেলা করলেও তা’র প্রভাব সবসময়ে বোঝা যায় না। কিন্তু যখনই ব্যবসায়ে কিছুটা মন্দাভাব আসে, তখন এই ব্যবাপারটা খুব তীব্র হয়ে পড়ে। ক্যাশ-ফ্লোতে বাঁধা আসা শুরু করে। তাই একেবারে ছোট ব্যবসায়ীরও উচিৎ সর্বদা ফাণ্ড ব্যবস্থাপনায় মনযোগী হওয়া এবং ক্যাশ-ফ্লো চাঙা রাখা।
খুব সহজভাবে বলতে গেলে, ব্যবসায়ে যা টাকা আসলো, সেটা যদি যা বের হয়ে গেল তা’র বেশি হয়, তা’হলে আমরা বলতে পারি যে ক্যাশ-ফ্লো পজিটিভ। ব্যয় বেশী হলে সেটা নেগেটিভ। অর্থাৎ, ব্যবসায়ের নির্বাহী ব্যয় সবসময়ে অপেক্ষাকৃত কম বা নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই সফল ব্যবসায়ীর লক্ষণ। প্রায় ৮০% ভাগ ব্যবসায় অসফল ৭৬৬৬হয় নেগেটিভ ক্যাশ-ফ্লোর কারণে। ক্যাশ-ফ্লোর ঘাটতি হলে নিয়মিত যে নির্বাহী ব্যয় বা অপারেটিং এক্সপেন্স, যেমন – কর্মচারীদের বেতন, অফিস ভাড়া, ইত্যাদি, বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। দুর্যোগকালীন সময়ে ক্যাশ-ফ্লো অপ্রতুল হয়ে পড়লে কী কী ভাবে তা’ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে তা’ নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
(১) মুনাফার ভাগ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করা:
ক্যাশ-ফ্লোতে ঘাটতি হওয়ার সাথে সাথে এর কারণসমূহ অনুসন্ধান ও নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কারণে এই ঘাটতি হতে পারে, যেমন অপারেটিং এক্সপেন্স বেশী হয়ে যাওয়া, বা যথেষ্ট পেমেন্ট আদায় না হওয়া, অথবা ব্যাঙ্ক-লোনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। মার্কেটিং খরচ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলেও এ সমস্যা হতে পারে। একই সাথে এটাও বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে, এই ঘাটতি কি সাময়িক নাকি এর পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে। পরিস্থিতি ভালভাবে বিশ্লেষন করে ঠিক করতে হবে, ব্যবসায়ের কোন কোন পণ্য বা সেবা অধিক লাভজনক, আর কোন কোনটা সচেয়ে কম লাভজনক। অবশ্যই অধিক লাভজনক পণ্য বা সেবাকে এ সময়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। যে সব গ্রাহকের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে লাভের চেয়ে খরচ বেশী করতে হয়, সেসব গ্রাহক ছেড়ে দেওয়াটাই এই দুর্যোগের সময় বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আপনার পণ্য বা সেবার মূল্য-কাঠামোকেও পুনঃমূল্যায়ন করার দরকার হতে পারে। সবরকম অপচয় বন্ধ করতে হবে এবং যে খরচগুলো এখনই না করলেও চলে, সেগুলো বন্ধ করে অপারেটিং এক্সপেন্স যতদূর সম্ভব কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
(২) প্রাপ্য হিসাবসমূহকে ত্বরান্বিত করা:
সকল ব্যবসায়েই পাওনা আদায়ের একটা নির্দিষ্ট সাইকেল থাকে। কারও ক্ষেত্রে এটা এক মাস, কারও ক্ষেত্রে এটা তিন মাস হতে পারে। ক্যাশ-ফ্লোতে ঘাটতি দেখা দিলে এই চক্রকে ছোট করে নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ, যে গ্রাহক বিলের তারিখ থেকে তিন মাস পর তা’ পরিষোধ করতো, তা’কে অনুরোধ করে পরিশোধের সময় দুই মাসে নিয়ে আস্তে হবে; অথবা যে সময় নিত এক মাস, তা’কে পনের দিনে নিয়ে আস্তে হবে।
নতুন গ্রাহকের ক্ষেত্রে এই পরিষোধের সময় সবচেয়ে নূন্যতম সীমায় রাখতে হবে। সম্ভব হলে প্রিপেড সেবাও দেওয়া যেতে পারে। আগাম বা আংশিক পেমেন্টের জন্যও গ্রাহককে রাজী করাতে পারেন।
মাসিক বিল আদায়ের সময় সংক্ষিপ্ত করার জন্য বিল দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিল পাওয়ার পরই গ্রাহক তা’র পরিষোধের কার্যক্রম শুরু করে। তাই, তাড়াতাড়ি বিল পাঠালে তাড়াতাড়ি সেটা আদায়ের সহনসাধ্য হবে। সম্ভব হলে আংশিক কাজ শেষ হলে, সেই অংশের বিলও পাঠিয়ে দিতে পারেন। গ্রাহকের সাথে আলোচনা করেই অবশ্য এ কাজটা করতে হবে। এক্ষেত্রে চুক্তির সময়েই প্রো-রাটা বিল পরিষোধের শর্ত রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
পুরানো পাওনাসমূহকে আদায়ের ব্যবস্থা হাতে নিতে হবে। এজন্য আলাদা একটা কালেকশন টীমও তৈরি করা যেতে পারে। অনাদায়ী বিল শুধু আপনার ব্যবসায়কে বঞ্চিতই করে না, এটার জন্য ফাইনান্স কস্টও গুণতে হয়। সম্পূর্ণ না পেলেও যদি আংশিক আদায়ও হয়, সেটাও এ মুহূর্তে আপনার ব্যবসায়ের জন্য সহায়ক হবে।
গ্রাহকদের জন্য বিল পরিষোধের বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি রাখা প্রয়োজন, যাতে কেউ চাইলে অনলাইনে, ক্রেডিট কার্ডে, বা মোবাইল ফাইনানশিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পরিষোধ করতে পারে।
(৩) আপসের মাধ্যমে প্রদেয় হিসাব বিলম্বিত করা:
ক্যাশ-ফ্লো অব্যাহত রাখতে ব্যয় কমানোর সাথে সাথে, যেসব নিয়মিত প্রদেয় রয়েছে সেগুলোকে বিলম্বিত করাটা কৌশুলী হবে। পাওনাদারদের সাথে এ ব্যাপারে দরাদরি করতে হতে পারে। একটা আপস-মীমাংসা করে যদি পাওনাগুলোকে কয়েকটা কিস্তিতে ভাগ করা যায়, তা’ ব্যবসায়ের ক্যাশ-ফ্লোর উপর চাপ লাঘব করবে।
(৪) অর্থ ঋণের ব্যবস্থা করা:
চালু মূলধন বা ক্যাশ-ফ্লোতে ঘাটতি দেখা দিলে ঋণের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এই ঋণ ব্যাঙ্ক থেকে হতে পারে, কিংবা কোন ব্যক্তির কাছে থেকে। যেটাই হোক না কেন, এটা মনে রাখাটা এখানে খুবই জরুরী যে, ঋণ নিলে সুদ সমেত তা’ পরিষোধ করতে হবে। তাই সুদের হার এবং অন্যান্য শর্তাবলী মনোযোগ সহকারে আগে থেকেই পরীক্ষা করে নিতে হবে। অনেক সময়েই দেখা যায়, ঋণের অর্থ সাময়িকভাবে ক্যাশ-ফ্লোর ঘাটতি মেটাতে পারলেও, পরবর্তীতে তা’ একটা বিশাল বোঝা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। এবং তখন এই ঋণ নিয়মিতভাবে পরিষোধ করে না পারার কারণে ব্যবসায় আবার টানাপোড়ন দেখা দিতে পারে। অর্থ ঋণের ব্যাপারে আরেকটা পরামর্শ হলো, যদি দেখা যায় ব্যবসায়ে এই ক্যাশ-ফ্লোর টানাটানি মাঝমাঝে লেগেই থাকে, সেক্ষেত্রে ঋণ নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ, ঋণ সাময়িকভাবে ক্যাশ-ফ্লোতে অর্থ যোগান দিতে পারবে মাত্র, সমাধান দিতে পারবে না। এক্ষেত্রে ঘাটতির কারণগুলো খুঁটিয়ে দেখা খুবই জরুরি।
(৫) নতুন বিনিয়োগকারী নিয়ে চালু মূলধন বাড়ানো:
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থ ঋণ না নিয়ে ব্যবসায়ে নতুন বিনিয়োগকারী বা পার্টনার নিয়ে আসার কথা ভাবা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে ব্যবসায়ের একটা অংশ বিক্রীত হয়ে যাবে এবং নতুন একজন অংশীদার তৈরী হবে। এ ধরণের বন্দোবস্ত অনেক পর্যালোচনা ও নিরীক্ষা করেই নিতে হবে। অর্থ-ঘাটতির চাপে পড়ে হঠাৎ করে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা একেবারেই ঠিক নয়।
(৬) প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ বিক্রয়:
অপ্রয়োজনীয় করচ কমিয়ে আনা এবং অপচয় রোধের সাথে সাথে কিছু প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ বিক্রী করার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এভাবে কিছু অর্থের দ্রুত যোগান হতে পারে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এই বিক্রয়লব্ধ অর্থ ফুড়িয়ে যেতে বেশী সময় লাগবে না, যদি না উপোরল্লিখিত ব্যবস্থা-সমূহ সময়োচিতভাবে না নেওয়া হয়।
চলমান করোনাভাইরাস দুর্যোগে আমরা দেখেছি যে, ব্যবসায়ের পরিবেশ কত দ্রুত সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। ব্যবসায়ীরা যদি পরিস্থিতির পূর্বাভাসগুলি নিয়মিত পর্যালোচনা করে সুজ্ঞাত ও উপযুক্ত সিদ্ধান্তগুলো সুপরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তা’হলেই ক্যাশ-ফ্লো অব্যাহত থাকবে এবং তাঁদের ব্যবসায়কে টিকিয়ে রাখতে পারবেন।
জিএসনিউজ/এমএইচএম/এএএন