ডাকসু নির্বাচন প্রার্থিতা প্রত্যাহারে নির্যাতনের অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বিভিন্ন হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপও দিচ্ছে তারা। এদিকে প্রতিটি হলে জোর করে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ও চাপ প্রয়োগের প্রতিবাদে উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের সাংস্কৃৃতিক সম্পাদক পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহবুবুর রহমান সাজিদকে প্রায় ১৩ ঘণ্টা আটকে রেখে মারধর করা হয়। গত শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে তাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। একই পদের ছাত্রলীগের প্রার্থী মোস্তফা সরকার মিসাদসহ অন্যান্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পর ওই প্রার্থী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হল প্রশাসনকে মৌখিক অভিযোগ দেন। অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করেছে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সাজিদ যখন হল সংসদ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন তখন থেকেই ছাত্রলীগের একটি পক্ষ তাকে সরানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছিল। কিন্তু তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় শুক্রবার রাত ৯টার দিকে বইমেলা থেকে ধরে নিয়ে গতকাল শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আটকে রেখে তাকে নির্যাতন করা হয়। সকালে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে একটি চিঠি লিখতেও বাধ্য হন তিনি।
সাজিদ নিজে অভিযোগ করেন, রাত ৯টার দিকে ছাত্রলীগ প্যানেলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোস্তফা সরকার মিসাদ, মুজাহিদ, আরিফ, অনিকসহ প্রায় পাঁচ থেকে সাতজন তাকে বইমেলা থেকে ধরে আনে। পরে হলের ১১১ নম্বর রুমে তাকে আটকে রেখে প্রথম দফায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। এরপর গভীর রাতে যখন তাকে পুনরায় নির্যাতন করা হয় তখন তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহারে রাজি হন। এরপর সকাল ১০টার দিকে তাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার সম্পর্কে একটি দরখাস্ত লিখে হল অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, পরে তিনি হলের প্রাধ্যক্ষকে বিষয়টি অবহিত করলে হল প্রাধ্যক্ষ তার প্রত্যাহারপত্রটি ছিঁড়ে ফেলেন। পরে তার ওপর নির্যাতনের বিষয়টি সম্পর্কে একটি অভিযোগপত্র লিখতে বলেন। আজ সকালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করবেন বলে জানান সাজিদ। সাজিদের নিরাপত্তার জন্য এস এম হলের ছাত্রলীগ মনোনীত জিএস প্রার্থী জুলিয়াস সিজারকে দায়িত্ব দিয়েছে হল প্রশাসন। মারধরের বিষয়টি স্বীকার করে জুলিয়াস সিজার বলেন, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। ১১ মার্চের মধ্যে যদি এ ধরনের কোনো নির্যাতন করা হয় তবে তিনি সাজিদের হয়ে কাজ করবেন বলে জানান।
এদিকে বিভিন্ন হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য ‘চাপ’ দিচ্ছে ছাত্রলীগ। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে শুক্রবার রাত ৩টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ডাকসুর ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য প্রার্থীদের চাপ দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, শুক্রবার রাতে শোভন মুহসীন হলে তার নিজের কক্ষে হল সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া শিক্ষার্থীদের ডেকে পাঠান। শনিবার দুপুর ১২টার মধ্যে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন শোভন। এ সময় শোভনের সঙ্গে ওই কক্ষে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের মুহসীন হল শাখার সভাপতি সরকার জহির রায়হান ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী, ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে মুহসীন হলে ভিপি প্রার্থী তৌহিদুল হক শিশির ও জিএস প্রার্থী মেহেদী হাসান মিজান প্রমুখ।
মুহসীন হল সংসদে বিভিন্ন পদে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জানান, শুক্রবার রাতে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও হলের নেতারা চাপ সৃষ্টি করেন। প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে হলে তাদের সমস্যা হবে- এমন কথা বলে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। গতকাল শনিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সুযোগ ছিল।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মুহসীন হল সংসদে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী তৌহিদুল হক শিশির বলেন, ছাত্রলীগের যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, সংগঠনের স্বার্থে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়েছে, বাইরের কাউকে বলা হয়নি।
এ ছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল সংসদের একটি সম্পাদক পদের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে হলের অতিথি কক্ষে ডেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একই দিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল সংসদের এক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়া হয়। শুক্রবার রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদে জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ হাসানকেও হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হয়রানি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল সংসদে বামপন্থি দুই জোটের জিএস প্রার্থী শাহাবউদ্দিনকে জোরপূর্বক মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করিয়েছেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতারা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী সমকালকে বলেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় যেহেতু শেষ, তাই এটি আর প্রাসঙ্গিক নয়। হল প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য বলা হচ্ছে। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে হল প্রশাসনকে জানাতে হবে। সব প্রার্থী প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাবেন।
এদিকে প্রতিটি হলে জোর করে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে চাপ প্রয়োগের প্রতিবাদ জানিয়েছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান। শনিবার দুপুরে এ বিষয়ে উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগপত্র জমা দেন তিনি। একই সঙ্গে ভোট গ্রহণের সময়সীমা বাড়ানোর দাবিও জানান তিনি।
এ বিষয়ে আসিফুর রহমান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার রয়েছে। তিনি স্বতন্ত্রভাবে ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদে অংশ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে বিভিন্ন হলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
এদিকে রঙিন পোস্টার ছাপানো ও দেয়ালে লাগানোর ব্যাপারে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদের ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের বিরুদ্ধে অভিযোগকে মিথ্যা বলে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রলীগ। শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ প্রতিবাদ জানানো হয়।



