সংলাপে সন্তুষ্ট নয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট

স্টাফ রির্পোটারঃ>>>>>
বহুল প্রত্যাশিত সংলাপে সন্তুষ্ট নয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সংলাপ শেষে বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে বেরিয়ে বেইলি রোডের বাসায় এক আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, সংলাপ থেকে তেমন কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।
সভা-সমাবেশ করতে দেওয়ার বিষয় ছাড়া তাদের ৭ দফা দাবির কোনোটিই মানতে রাজি হয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ।
সংলাপ থেকে বের হয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন ‘ভালো আলোচনা’ হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন সাংবাদিকদের। পরে তার বাসায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, সংলাপে তারা কোনো ‘সমাধান’ পাননি। ফ্রন্টের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তুলে ধরেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী।
জাতীয় ঐক্যফ্রান্টের প্রধান দল বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য সংলাপ থেকে বের হয়েই জানিয়েছিলেন, আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট নন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামীলীগের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে গণফোরাম, বিএনপি, জেএসডি ও জাতীয় ঐক্যফোরামের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। অন্যদিকে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামীলীগসহ ১৪ দলের প্রতিনিধিরা।
নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে নিয়ে জোট গঠন করে যে সাত দফা তুলে ধরেন কামাল, তার মূল দাবি হল খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি নিয়ে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ভোটের সময় বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন ও সভা-সমাবেশে বাধা অপসারণের দাবিও তোলে ঐক্যফ্রন্ট।
গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় আলোচনার আহ্বান জানিয়ে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে আওআমীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদ ওবায়দুল কাদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। পরদিন ওবায়দুল কাদের সংলাপে বসার নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানান। তার প্রেক্ষিতে আজ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আলোচনায় বসে দুই পক্ষ।
জাতীয় ঐক্যফ্যন্টের সংবাদ সম্মেলন
সংলাপ শেষ হওয়ার প্রায় ২ ঘন্টা পর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেইলি রোডের ড. কামাল হোসেনের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানায় জাতী ঐক্যফ্রন্ট।
ড. কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাড়ে তিন ঘণ্টার সংলাপে মাত্র একটি বিষয়েই সমাধান মিলেছে। গণভবনে আমরা আমাদের দাবি তুলে ধরেছি। সবার কথা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী লম্বা বক্তৃতা দিলেন। বিশেষ কোনও সমাধান আমরা পাইনি।
সংলাপ শেষে সংবাদ সম্মেলনে কামালের আহ্বানে গণফোরামের কার্যকরি সভাপতি সুব্রত চৌধুরী এসব বিষয়ে তাদের আলোচনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “সংলাপের শুরুতে ড. কামাল হোসেন সূচনা বক্তব্য রেখেছেন। এরপর বিএনপি মহাসচিব ৭ দফা দাবি তুলে ধরেছেন।”
সংলাপে এক পক্ষের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সংলাপে এক পক্ষের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সংলাপে অন্য পক্ষের নেতৃত্বে কামাল হোসেন সংলাপে অন্য পক্ষের নেতৃত্বে কামাল হোসেন
সভা-সমাবেশে বাধা অপসারণের আশ্বাস পাওয়ার কথা জানিয়ে সুব্রত চৌধুরী বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকাসহ সারাদেশে সভা-সমাবেশে কোনো বাধা থাকবে না। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নির্দেশ দিয়েছেন।”
রাজনৈতিক মামলা থাকলে তার তালিকা প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “উনি বলেছেন, তালিকা আপনারা দেন। আমি অবশ্যই বিবেচনা করব যাতে হয়রানি না হয়।”
উত্থাপিত দাবি-দাওয়া নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনার দ্বার খোলা রাখার প্রতিশ্রুতিও প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন বলে জানান সুব্রত।
খালেদা জিয়ার মুক্তির যে বিষয়টি বিএনপির সবার আগে আনছে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন- সাংবাদিকরা জানতে চান দলটির মহাসচিব ফখরুলের কাছে।
বিমর্ষমুখে থাকা বিএনপি মহাসচিব বলেন, “তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে পরবর্তীতে আরও আলোচনা হতে পারে।”
বিরোধ সমাধানের আগে নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা হবে কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমরা তফসিলের বিষয়ে বলেছি। উনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, তফসিল দেওয়ার এখতিয়ার নাই। সেটা নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।”
এর মধ্যে কামাল বলেন, “আমরা সংলাপের সুযোগ পেয়েছি। আমরা আমাদের কথা বলে এসেছি উনাকে। উনি জানতে পেরেছেন। উনি উনার কথাগুলো বলেছেন। উনার মনের কথাও আমরা কিছুটা জানতে পেরেছি।”
জেএসডি সভাপতি ও ফ্রন্টের মুখপাত্র আ স ম আবদুর রব বলেন, “আমরা ৭ দফা দিয়েছি, মানা না মানার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের আন্দোলন চলবে,”।
ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য
সংলাপ শেষে আওয়ামীলীগের পক্ষে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নিয়ে গণভবনে সাংবাদিকদের সামনে আসেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, “খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনেছেন। কারও কারও কথা তিন-চারবার শুনেছেন। কোনো বাধা দেননি, একটুও অধৈর্য হননি।
“আমাদের সিনিয়র নেতারাও কথা বলেছেন। তারা কিছু অভিযোগ করেছেন। আমাদের নেতারা তার জবাব দিয়েছেন।”
নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে ফ্রন্ট নেতারা কথা বলেছেন জানিয়ে কাদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সভা-সমাবেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। তবে কোনো রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা কর্নার ঠিক করে দেওয়া হবে। সেখানে সব দল সভা-সমাবেশ করতে পারবে। বিনিময়ে একটা কিছু টাকা নেওয়া হবে।”
নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক রাখার বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দাবি ছিল সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। কিন্তু আমরা সংবিধানের বাইরে যাব না। একটি ব্যাপার পরিষ্কারভাবে বলেছি, ড. কামাল হোসেন সাহেবের চিঠির উত্তরেও একটি কথা লেখা ছিল। সেখানে বলা ছিল, সংবিধানসম্মত সকল বিষয় আলোচিত হবে, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার বিষয়। কাজেই উই ক্যান নট গো বিয়ন্ড দ্য কনস্টিটিউশন।’
সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের দাবি সংলাপে নাকচ হয়েছে দাবি করে কাদের বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ ভেঙে নির্বাচন হয় না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। আসলে নির্বাচনের সব দায় দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। শিডিউল ঘোষণার পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ইলেকশন কমিশনের ওপর ন্যস্ত হবে। কাজেই এসব বিষয়ে তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, তাদের শঙ্কার কোনো কারণ নেই।’
রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে সংলাপে ড. কামাল হোসেন এবং মির্জা ফখরুল ইসলামের কাছ থেকে তালিকা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। সেই তালিকা দেখে যেটা রাজনৈতিক মামলা মনে হবে, সেটা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনকে আমাদের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আপনিই বলুন, আপনিও তো ইলেকশন করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে বহু নির্বাচনই হয়েছে এই দেশে। এসব নির্বাচনের মধ্যে কেবলমাত্র ২০০১ সালেই একবার সেনাবাহিনীকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া কোনো নির্বাচনে বাংলাদেশে সেনাবহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ছিল না। কাজেই এখন কেন চান?’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিষয়ে কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটা আইনের ব্যাপার, আদালতের বিষয়। আইন আদালতের বিষয়ের সঙ্গে সংলাপে কোনো বিষয় আসতে পারে না। যে দুটি মামলায় তাঁর দণ্ড-হয়েছে, এটা কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলা। আমাদের নেত্রী এটাই বলেছেন, এটা তিনি ফাইল করেননি। এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলা। সে সরকারের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা বিএনপির লোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা ছিল। সেগুলো তদন্ত করে রিপোর্ট হয়েছে, কোনো মামলা প্রত্যাহার হয়নি।’
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাদের বলেন, সরকার প্রধান বলেছেন, ইভিএম আধুনিক পদ্ধতি, সাপোর্ট করি। তবে এবার ইভিএম হয়তো নির্বাচন কমিশন সীমিতভাবে ব্যবহার করবে। এতে আমাদের সমর্থন থাকবে। তবে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভোট পর্যবেক্ষণে সকারের কোনো আপত্তি থাকবে না।
আবার সংলাপ হবে ক-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “তারা (ঐক্যফ্রন্ট) আসলেই হবে। তারা যদি মনে করেন, আশা দরকার। তাহলে আমাদের খবর দিলে আমরা অবশ্যই নেত্রীর পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানাব।”